বাংলাদেশ

একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে হকারকে গলা কেটে হত্যা

Advertisement

বাংলাদেশের আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে যাত্রী হয়রানি এবং হকারদের দৌরাত্ম্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু সেই সমস্যা এবার ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দিলো। একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে পপকর্ন ও নারিকেল বিক্রেতাদের মধ্যে বিরোধের জেরে আল আমিন নামের এক হকারকে চলন্ত ট্রেনে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। একই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন মিলন নামে আরও একজন।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাতে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে যাওয়ার পথে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ স্টেশন অতিক্রম করার পরই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ট্রেনটি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছালে যাত্রীরা রক্তাক্ত অবস্থায় দু’জনকে নিচে নামিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক আল আমিনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত মিলন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

নিহত আল আমিন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চড়বথুয়াতুলি গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে। আহত মিলনও একই গ্রামের বাসিন্দা।

বিরোধের সূত্র: ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব

ট্রেনে নিহত আল আমিনের চাচাতো ভাই মাহবুবুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনে পণ্য বিক্রি করা হকারদের মধ্যে বিভিন্ন বগিতে ‘কার কোন এলাকায় বিক্রি করার অধিকার থাকবে’—এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে চাঁদাবাজির মতো একটি অনিয়ম তৈরি হয়েছে। বিশেষত নারিকেল ও পপকর্ন বিক্রেতা আকাশ, সুজন ও কুদরতের সঙ্গে আল আমিনের বিরোধ কয়েক দিন ধরেই তীব্র ছিল।

মাহবুবুর বলেন, “ব্যবসার জায়গা নিয়ে আগেও কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সোমবার রাতে সেতাবগঞ্জ স্টেশন ছাড়ার পর প্রতিপক্ষরা হঠাৎ ছুরি নিয়ে আল আমিনের উপর হামলা করে। গলা কেটে পালিয়ে যায়। মিলন ভাইও বাধা দিতে গিয়ে আহত হন।”

চলন্ত ট্রেনে যাত্রীদের সামনে এভাবে একজনকে হত্যা করা শুধু ভয়াবহই নয়, বরং দেশের রেলপথে নিরাপত্তাহীনতার কী পর্যায়ে পৌঁছেছে তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

যাত্রীদের আতঙ্ক: রেলপথ কি আর নিরাপদ?

ঘটনার পর ট্রেনের যাত্রীরা প্রচণ্ড আতঙ্কে পড়ে যান। অনেকেই বলেন, এখন ট্রেনে ওঠা মানেই জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। হকারদের নিয়ন্ত্রণহীন উপস্থিতি, বগির পর বগি চাঁদাবাজি আর মারামারি—সবই নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাসেল নামে এক যাত্রী বলেন, “ট্রেনের ভেতরে হকারদের যে দৌরাত্ম্য—তা রেল পুলিশের চোখে পড়ে না কেন? প্রতিটি বগিতে অনেকে টাকা তোলে, ঝগড়া করে, মারামারি করে। কেউ সামাল দিতে আসে না।”

আরেক যাত্রী ইসলাম বলেন, “আমরা যাত্রী হয়ে ট্রেনে উঠি, কিন্তু নিরাপত্তা কোথায়? দেশের বড় বড় ট্রেনে যদি গলা কেটে হত্যা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করবে? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভাড়া নিতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তা দিতে পারে না।”

মাহির নামের আরেক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “খুন হলেও শুধু শোনা যায়—‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। কিন্তু বাস্তবে কোন পরিবর্তন আসে না। এইভাবে চললে রেলের প্রতি জনগণের আস্থা কমতেই থাকবে।”

রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের বক্তব্য

পীরগঞ্জ রেলস্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার আব্দুল আজিজ বলেন, “স্টেশনে ট্রেন পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দুইজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামানো হয়। পরে হাসপাতাল নেওয়ার পর একজন মারা গেছেন। শুনেছি তারা ট্রেনের হকার। রেলওয়ে পুলিশকে জানানো হয়েছে।”

পীরগঞ্জ থানার ওসি তাজুল ইসলাম জানান, “খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে যায়। হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ায় কাউকে আটক করা যায়নি। রেলওয়ে পুলিশ তদন্ত করছে।”

দিনাজপুর রেলওয়ে পুলিশ বলছে, এটি ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে ঘটেছে। তবে তারা ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

দেশজুড়ে রেলপথে নিরাপত্তাহীনতা: কেন বাড়ছে এমন ঘটনা?

বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে গত কয়েক বছর ধরে—

– ট্রেনে ছিনতাই
– হকারদের চাঁদাবাজি
– বগিতে যাত্রী হয়রানি
– গ্রুপভিত্তিক আধিপত্য
– ভুয়া টিকিট সিন্ডিকেট

এমন নানা অপরাধ বাড়ছে। নিয়মিত টহল না থাকা, পর্যাপ্ত রেল পুলিশ না থাকা, স্টেশনগুলোর নজরদারি দুর্বলতা এবং হকারদের সংগঠিত চক্র—এসব কারণে যাত্রী নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে ঝুঁকিতে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলওয়ে পুলিশকে আধুনিকায়ন এবং বগিতে নির্দিষ্ট নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ ছাড়া এমন ঘটনা থামানো যাবে না।

কেন হকারদের মধ্যে বিরোধ তীব্র?

যুক্ত কারণগুলো হলো:

১. প্রতিটি বগিতে কোন হকার কী বিক্রি করবে—এ নিয়ে অঘোষিত দখলবাজি
২. বগি নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী স্থানীয় চক্রের সম্পৃক্ততা
৩. যাত্রী চাঁদাবাজি ও নানা অবৈধ আয় ভাগাভাগি
৪. দীর্ঘদিন ট্রেনে ব্যবসা করা হকারদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধ
৫. রেল পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে অপরাধীদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা

এই কারণে প্রায়ই মারামারি, কাটাকাটি ও সংঘর্ষ ঘটে থাকে। যদিও অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না, আল আমিন হত্যার পর বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

একতা এক্সপ্রেসে কীভাবে ঘটে গেল এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড?

সাক্ষীদের বর্ণনা অনুযায়ী:

– সেতাবগঞ্জ স্টেশন ছাড়ার পরই তিনজন প্রতিপক্ষ আল আমিনকে চেপে ধরে
– হঠাৎ ছুরি বের করে গলা লক্ষ্য করে আঘাত করে
– মিলন বাধা দিলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়
– সবকিছু ঘটেছে কয়েক মিনিটের মধ্যে
– ট্রেনে রেল পুলিশ বা নিরাপত্তার দায়িত্বে কেউ ছিলেন না
– যাত্রীরা চিৎকার করলেও অপরাধীরা দ্রুত পালিয়ে যায়

অর্থাৎ, একটানা কয়েক মিনিট ধরে সংঘর্ষ চললেও কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিল না—যা রেল ব্যবস্থাপনার বড় ব্যর্থতা।

যাত্রীরা যা বলছেন—তদন্তে যা সামনে আসতে পারে

যাত্রীদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে শুধু ব্যক্তিগত বিরোধ নয়, বরং হকারদের নিয়ন্ত্রণে একটি বড় গোষ্ঠী কাজ করে। তদন্তে পাওয়া যেতে পারে—

– ট্রেনে নির্দিষ্ট চক্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে
– তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়
– নতুন হকার এলে বাধা দেয়া হয়
– টিকিটবিহীন উঠানামাও তাদের নিয়ন্ত্রণে
– রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু চক্রের অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে কিনা

যদি এসব দিক তদন্তে প্রমাণিত হয়, তবে রেলপথে অন্ধকার একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে—এমনটাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

পরিবারের আহাজারি: ন্যায়বিচার চান তারা

নিহত আল আমিনের পরিবার শোকে মুহ্যমান। তাঁদের দাবি—ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হোক। পরিবার বলছে, আল আমিন নিয়মিত ট্রেনে হকারি করে জীবিকা চালাতেন। কিন্তু কিছু প্রতিপক্ষ তাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল।

পরিবারের প্রশ্ন—
“ট্রেনে এত লোকের সামনে একজনের গলা কেটে হত্যার পরও যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আর কত মানুষ মরতে হবে?”

রেলওয়ে কী বলছে?

রেলওয়ে পুলিশের প্রাথমিক মন্তব্য—
“ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত চলছে।”

তবে যাত্রীরা বলছেন, রেলের নিরাপত্তাহীনতার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হয়েছে যাত্রীদের অভিযোগ।

রেলপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি যে পদক্ষেপগুলো প্রয়োজন

১. প্রতিটি ট্রেনে বগিভিত্তিক রেল পুলিশ নিয়োগ
২. হকারদের নিবন্ধন ও নিয়মের আওতায় আনা
৩. বগিতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন
৪. যাত্রীরা অভিযোগ জানাতে তাৎক্ষণিক হেল্পলাইন চালু
৫. অননুমোদিত হকারদের প্রবেশ বন্ধ
৬. রেল পুলিশ ও স্টেশন ম্যানেজমেন্টের জবাবদিহিতা নিশ্চিত
৭. ট্রেনে অপরাধ ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে জরুরি স্টপেজ দেওয়ার ব্যবস্থা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ব্যবস্থা না নিলে রেল পথ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে হকার আল আমিনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়—এটি বাংলাদেশের রেলপথের নিরাপত্তাহীনতার নগ্ন বাস্তবতা। যাত্রীরা আতঙ্কে, সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন, আর পরিবার হারিয়েছে তাদের উপার্জনক্ষম সদস্যকে। রেল ব্যবস্থাপনায় যদি পরিবর্তন না আসে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা আরও ঘটতে পারে।

SignalBD পাঠকদের উদ্দেশে বলা যায়—রেলপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। পুলিশ তদন্তের ফলাফল যাই হোক, এই হত্যাকাণ্ড একটি সতর্কবার্তা—রেলপথ আর নিরাপদ নয়, যদি না এখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

MAH – 13973 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button