বাংলাদেশে আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ প্রবেশ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় শহরগুলোতে সন্ত্রাসী চক্রের সক্রিয়তা বেড়েছে। ঢাকার মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড, চট্টগ্রামে নির্বাচনী প্রচারের সময় গুলির ঘটনা—এসব ঘটনার পেছনে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে সংগঠিত অপরাধীদের দাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে আধুনিক অস্ত্র
পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত ঢুকছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও অ্যামুনিশন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সীমান্ত স্থান হলো টেকনাফ, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, মেহেরপুর এবং আরও অন্তত ১২টি পয়েন্ট।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, নদীপথ, ট্রানজিট রুট, নাফ নদীর অগভীর অংশ, ছোট দ্বীপাঞ্চল ব্যবহার করে অস্ত্র চোরাচালান হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জুলাই মাসের বিভিন্ন থানায় লুট হওয়া ৫,৭৬৩টি অস্ত্রের মধ্যে ১,৩৪০টি এখনো নিখোঁজ।
এ ধরনের অস্ত্র এখন দেশের বড় বড় গ্যাং ও মাফিয়ার হাতে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এই অস্ত্র ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হতে পারে।
অভিযান এবং অস্ত্র উদ্ধার
র্যাব গত চার মাসে ১৮৯টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে, এবং বিজিবি ৯ মাসে ১,২২৫টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। কিন্তু পুলিশের নিখোঁজ অস্ত্র শনাক্তকরণে এখনো বড় অগ্রগতি হয়নি। গোয়েন্দাদের মতে, দেশের ৭৫টির বেশি গ্যাং এখন স্বয়ংক্রিয় বিদেশি অস্ত্রের মালিক।
রাজনৈতিক সমর্থনের ছায়া
নিরাপত্তা সংস্থা ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কিছু গ্যাং রাজনৈতিক নেতারা, শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাথে গোপন যোগাযোগ রাখছে। তাদের উদ্দেশ্য মূলত নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা অস্থিতিশীল করা, এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি এবং অপরাধকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এএইচএম শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে অপরাধী চক্রের সক্রিয়তা নিয়মিত নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। যে কোনো চক্র নির্বাচনী সহিংসতা, চাঁদাবাজি, কেন্দ্রে দখল বা অস্ত্র ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্যাং এবং রাজনৈতিক নেতা সম্পর্ক
গোয়েন্দাদের মতে, নির্বাচনের সুবিধা নিশ্চিত করতে কিছু রাজনৈতিক নেতা গ্যাংকে ‘হায়ার্ড মাসল’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ভোটভীতি তৈরি করা, বিরোধীদের প্রচারে হামলা, কেন্দ্রে দখল নেওয়া, এলাকায় আধিপত্য স্থাপন—এসব কাজে অপরাধী চক্রকে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া পুলিশের কর্মকর্তা জানান, রাজধানী ঢাকায় কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার আশীর্বাদে আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়াদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—ডিএমপি, র্যাব, বিজিবি—এসব গ্যাং দমনে কাজ করছে। অস্ত্র উদ্ধার ও সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কাজ সীমিত। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
- রাজনৈতিক সহায়তা: গ্যাং নেটওয়ার্কে রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর। রাজনৈতিক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।
- গ্যাং-অস্ত্র-অর্থের জটিলতা: হুন্ডি নেটওয়ার্ক, অনলাইন লেনদেন এবং রেমিট্যান্স চ্যানেল পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ সংগ্রহে আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রয়োজন।
- ধীর বিচার প্রক্রিয়া: দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তি না থাকায় গ্যাং সদস্যরা সহজেই অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে। সহজ জামিন এবং দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া অপরাধীদের স্বস্তির কারণ।
সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও সচেতনতা
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই রাজধানীসহ সারাদেশে টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে এবং সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে।
দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ প্রবেশ এবং গ্যাংগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্কতা ও অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা সংস্থা সচেতন থাকলে, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব।
MAH – 13958 I Signalbd.com



