ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার জন্য বিদেশে অবস্থানরত প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি ভোটার নিবন্ধিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম পর্বের নিবন্ধন শেষে মোট ১৭ হাজার ৯০৭ জন প্রবাসী ভোটার ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নাম নিবন্ধন করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই প্রথম দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ১৬ হাজার ৩৫৫ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ১ হাজার ৫৫২ জন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন গত ১৮ নভেম্বর অ্যাপটি উদ্বোধন করেন।
নিবন্ধনের প্রাথমিক পরিসংখ্যান ও আঞ্চলিক চিত্র
ইসি ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী, প্রথম পর্বের নিবন্ধনের পরিসংখ্যানে কিছু নির্দিষ্ট দেশে প্রবাসীদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে।
প্রথম পর্বের অঞ্চলসমূহ: প্রথম পর্বে পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোটের জন্য নিবন্ধন করেছেন। ১৯ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই নিবন্ধন কার্যক্রম চলে।
প্রধান অংশগ্রহণকারী দেশ: নিবন্ধনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায় (৭ হাজার ৭৬৮ জন)। এরপরে রয়েছে জাপান (৪ হাজার ৬০৬ জন), দক্ষিণ আফ্রিকা (২ হাজার ৩১১ জন) এবং চীন (১ হাজার ২৮৯ জন)। এই দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ বিদেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রতি তাদের আগ্রহের প্রমাণ।
মোট ভোটারের তালিকা: প্রথম পর্বে মোট ১৭ হাজার ৯০৭ জন ভোটার নিবন্ধন করেছেন। এই সংখ্যা প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও, প্রথমবারের মতো শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার জন্য এটি একটি ইতিবাচক সূচনা হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন।
পোস্টাল ভোটিং প্রক্রিয়া: ও সিভি (OCV) এবং আইসিপিভি (ICPV)
প্রবাসী এবং দেশের অভ্যন্তরে থাকা নির্দিষ্ট কিছু ভোটারের জন্য এই পোস্টাল ভোটিং প্রক্রিয়াকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
আউট অব কান্ট্রি ভোটিং (OCV): প্রথমবারের মতো বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য এই ওসিভি প্রক্রিয়াটি চালু করা হয়েছে। প্রবাসীরা ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে নিবন্ধন করে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন। ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এই উদ্যোগকে নির্বাচনি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে উল্লেখ করেছেন।
ইন-কান্ট্রি পোস্টাল ভোটিং (ICPV): দেশের অভ্যন্তরে থাকা ভোটারদের জন্য আইসিপিভি সুবিধা চালু করা হচ্ছে। নির্বাচনি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ভোটার, আইনি হেফাজতে থাকা ভোটার (যেমন কারাবন্দী), এবং নিজ ভোটার এলাকার বাইরে অবস্থানরত সরকারি চাকরিজীবীসহ প্রায় ১০ লাখ ভোটারকে এই সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এটি নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে আরও অংশগ্রহণমূলক করবে।
পোস্টাল ব্যালটের নিবন্ধন পদ্ধতি ও সময়সূচি
নির্বাচন কমিশন মোট ১৪৮টি নির্দিষ্ট দেশে পোস্টাল ভোটিং নিবন্ধনের জন্য সময়সূচি ঘোষণা করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছে।
অ্যাপের ব্যবহার: প্রবাসীদের Google Play Store বা App Store থেকে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড ও ইনস্টল করতে হবে। অ্যাপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং নির্দেশাবলি সম্পর্কে জানা যাবে। ব্যবহারকারী বাংলা বা ইংরেজি যেকোনো একটি ভাষা নির্বাচন করতে পারবেন।
মোবাইল নম্বর বাধ্যবাধকতা: নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় প্রবাসী ভোটার যে দেশ থেকে ভোট দিতে ইচ্ছুক, কেবল সেই দেশের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করতে হবে। এটি ভোটারের অবস্থান যাচাই এবং প্রক্রিয়াটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য জরুরি।
নিরাপদ ঠিকানা: বিদেশে পোস্টাল ব্যালট প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ইসি কর্মকর্তারা নির্ভুল ঠিকানা দেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন। ব্যালট পেপার যাতে সুরক্ষিতভাবে ভোটারের হাতে পৌঁছায় এবং ভোট দেওয়ার পর আবার ইসিতে ফেরত আসে, তা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
পরবর্তী ধাপের সময়সূচি এবং চ্যালেঞ্জ
প্রথম পর্বের সফল নিবন্ধনের পর নির্বাচন কমিশন পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঞ্চলে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করবে।
দ্বিতীয় পর্ব (উত্তর আমেরিকা, ওশেনিয়া): ২৪ থেকে ২৮ নভেম্বর এই অঞ্চলের প্রবাসীরা নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন।
ইউরোপীয় পর্ব: ২১ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউরোপের দেশগুলোতে নিবন্ধন চলবে।
মধ্যপ্রাচ্যের সূচি: সৌদি আরবে ৪ থেকে ৮ ডিসেম্বর এবং দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৯ থেকে ১৩ ডিসেম্বর নিবন্ধন হবে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে ১৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বর কার্যক্রম চলবে।
প্রচারণার চ্যালেঞ্জ: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত কোটি কোটি বাংলাদেশির কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে অনেক দেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও নির্বাচনি ইতিহাসে প্রভাব
নির্বাচন কমিশনের এই সাহসী পদক্ষেপটি দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই উদ্যোগ নির্বাচনের অন্তর্ভুক্তিমূলক দিককে শক্তিশালী করবে এবং বিদেশে থাকা নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করবে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গণভোটের বাড়তি দায়িত্ব: সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ উল্লেখ করেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিনে গণভোট আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব হলেও, তারা তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে প্রস্তুত।
প্রক্রিয়াগত চ্যালেঞ্জ: যদিও এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে ব্যালট পেপার বিদেশে পাঠানো, গ্রহণ করা এবং ভোটের গোপনীয়তা বজায় রেখে তা আবার সময়মতো দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা ইসির দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে।
ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ: “প্রথমবারের মতো বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য ভোটদান ওসিভি প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে, যা দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি। এছাড়া, প্রায় ১০ লাখ ভোটারকে আইসিপিভি ভোট সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে।”
গণতন্ত্রের পরিধি বিস্তার
জাতীয় নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার জন্য প্রায় ১৮ হাজার প্রবাসীর নিবন্ধন একটি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিধিকে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃত করছে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই প্রক্রিয়ার সফলতার ইঙ্গিত বহন করে। যদিও সামনে আরও অনেক আঞ্চলিক পর্ব বাকি এবং প্রক্রিয়াগত অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তবুও এই উদ্যোগ বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক করতে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
এম আর এম – ২৩৫৫,Signalbd.com



