জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশে কোরআনের সমাজ কায়েম না হলে দেশের জনগণের জীবনে স্থায়ী শান্তি ও মুক্তি আসবে না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, প্রচলিত কোনো তন্ত্রমন্ত্র বা ব্যবস্থা দিয়ে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাঁর মতে, সত্যিকারের মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রীয় আইন কোরআনের ভিত্তিতেই পরিচালনা করতে হবে।
রবিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সম্মিলিত ইমাম-খতিব জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। এই সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বিপুল সংখ্যক ইমাম ও খতিব অংশগ্রহণ করেন।
শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ প্রচলিত তন্ত্রমন্ত্র
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান দেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোর সমালোচনা করে বলেন, এগুলোর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
প্রচলিত ব্যবস্থার সমালোচনা: তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন সময়ে দেশে যেসব তন্ত্রমন্ত্র (রাজনৈতিক বা সামাজিক আদর্শ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিই জনগণের জীবনে শান্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।
একমাত্র সমাধান: তাঁর মতে, একমাত্র নবীজী (সা.) এর দেখানো পথে ফিরে যাওয়া এবং কোরআনের সমাজ কায়েম করাই পারে জনগণের জন্য সত্যিকারের মুক্তি বয়ে আনতে।
আইনের শাসন: তিনি জোর দিয়ে বলেন, যদি এদেশে কোরআনের জন্য আইন পরিচালিত না হয়, তাহলে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।
ইমামদের নেতৃত্বের গুরুত্ব
ডা. শফিকুর রহমান সমাজে ইমাম ও খতিবদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান এবং তাঁদের সামাজিক নেতৃত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ইমামদের নেতৃত্বে একটি সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
মসজিদ কমিটির কাঠামো: তিনি প্রস্তাব করেন যে, মসজিদ কমিটি অবশ্যই খতিব এবং ইমামদের পরামর্শে গঠিত হতে হবে।
করুণার পাত্র নন: জামায়াত আমির বলেন, সমাজের সেবায় নিয়োজিত খতিব এবং ইমামগণ কারও করুণার পাত্র হতে পারেন না; তাঁদের সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হতে হবে।
সামাজিক ইমাম: তিনি ব্যাখ্যা করেন, মসজিদে নামাজের যিনি ইমামতি করেন, তিনি যখন সমাজেরও ইমাম (সামাজিক নেতা বা পথপ্রদর্শক) হবেন, তখনই সমাজে সত্যিকারের পরিবর্তন ও মুক্তি আসবে। তিনি বলেন, “আমরা যখন জন্মগ্রহণ করি তখন আপনারা আমাদের ইমাম, আমরা যখন মৃত্যুবরণ করি তখনও আপনারা আমাদের ইমাম। সমাজের ফয়সালা মসজিদের মিম্বার থেকেই আসতে হবে।”
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও কোরআনের সমাজের ধারণা
ডা. শফিকুর রহমান তাঁর বক্তৃতায় ইতিহাসের আলোকে কোরআনের সমাজের ধারণা ব্যাখ্যা করেন এবং কেন এটি বর্তমান সমাজের জন্য জরুরি, তা তুলে ধরেন।
ঐতিহাসিক ভিত্তি: তিনি বলেন, ইসলামের ইতিহাসে যখনই কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখনই সেই সমাজ ছিল ন্যায়, ইনসাফ ও শান্তিতে পূর্ণ। তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের উদাহরণ দেন।
বর্তমান সমাজের সমস্যা: তাঁর মতে, সমাজের মূল সমস্যা ন্যায়বিচারের অভাব, দুর্নীতি এবং নৈতিকতার অবক্ষয়। এই সমস্যাগুলো প্রচলিত তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হচ্ছে না।
কোরআনের সমাধান: কোরআনের সমাজ কায়েম হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, দুর্নীতি দূর হবে এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ ফিরে আসবে, যা স্থায়ী শান্তির ভিত্তি হবে।
ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা
এই সম্মেলন মূলত ইমাম ও খতিবদের সমন্বয়ে গঠিত হলেও জামায়াত আমিরের বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
আদর্শিক সংগ্রাম: ডা. শফিকুর রহমান এই সম্মেলনকে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, সমাজের সর্বস্তরে পরিবর্তন আনতে হলে মসজিদকেন্দ্রিক নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে হবে।
দলের দৃষ্টিভঙ্গি: জামায়াতে ইসলামী বরাবরই বাংলাদেশে ইসলামী শাসন বা কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে আসছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা ইমাম ও খতিবদের সঙ্গে সমন্বয় ও সমর্থন সুসংহত করার বার্তা দেন।
ইমাম-খতিবদের প্রতি বিশেষ বার্তা
ডা. শফিকুর রহমান সম্মেলনে উপস্থিত হাজার হাজার ইমাম ও খতিবদের প্রতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন।
ঐক্য ও ভূমিকা: তিনি তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং সমাজে সঠিক ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিকতার প্রচার করার জন্য তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মনে করিয়ে দেন।
সমাজের পথপ্রদর্শক: ইমাম-খতিবদের শুধু নামাজের ইমাম না হয়ে সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করার তাগিদ দেন, যাতে তারা সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচার ও অশান্তি দূর করতে পারেন।
ক্ষমতায়নের আশ্বাস: মসজিদ কমিটিতে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণের যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে ধর্মীয় নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের সামাজিক ও সাংগঠনিক ক্ষমতায়নের একটি ইঙ্গিত।
সমাজ সংস্কারের বার্তা
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের ‘কোরআনের সমাজ কায়েম না হলে দেশে শান্তি ফিরবে না’—এই মন্তব্য বাংলাদেশের ধর্মীয়-রাজনৈতিক আদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। এটি প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং ইসলামী আদর্শের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের বার্তা দিয়েছে। ইমাম ও খতিবদের নিয়ে আয়োজিত এই সম্মেলন মূলত সমাজে ধর্মীয় নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার একটি কৌশল। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ধর্মনিরপেক্ষ মহল থেকে কী প্রতিক্রিয়া আসে, তা আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এম আর এম – ২৩৪০,Signalbd.com



