চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূল থেকে মাছ শিকারে গিয়ে কুয়াশার কারণে পথ হারিয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়া ‘এফবি মায়ের দোয়া’ নামের একটি ফিশিং ট্রলারসহ ২৬ জেলেকে ভারতীয় কোস্টগার্ড আটক করেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেলেপল্লীতে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক, হতাশা ও কান্নার ঢল।
পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন, নদী–সাগরের মধ্যে কয়েক দিন ধরে ঘন কুয়াশা থাকায় ট্রলারটি দিক হারিয়ে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ে। তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের আটক করে নিয়ে যায়।
এই ঘটনায় মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ট্রলারটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম।
ট্রলার মালিকের ভাষ্য: কুয়াশায় পথ হারিয়ে ভারতীয় জলসীমায় চলে যায় জেলেরা
জিডিতে মালিক জাহাঙ্গীর আলম লিখেছেন—
“গত শুক্রবার রাতে ‘এফবি মায়ের দোয়া’ নামের আমার মালিকানাধীন ফিশিং ট্রলারটি শেখেরখীল সমুদ্রঘাট থেকে মাছ ধরতে বঙ্গোপসাগরে রওনা দেয়। হঠাৎ ঘন কুয়াশা নেমে এলে ট্রলারটি সঠিক রাস্তা হারিয়ে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাছাকাছি এলাকায় ঢুকে যায়। তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড ট্রলারসহ ২৬ মাঝি-মাল্লাকে আটক করে নিয়ে যায়।”
জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করেন, জেলেরা কোনো অপরাধ করেননি।
“সমুদ্রের ঘন কুয়াশায় এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে আটকে নিয়ে গেছে, এটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগজনক।”
২৬ জেলের পরিচয়
আটক হওয়া ২৬ জেলের মধ্যে—
বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপের বাসিন্দা:
- মো. আলী চাঁন
- মো. জিয়াউল হক
- মো. ইউসুফ
- মো. জোবাইর
- ওসমান গণি
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার:
- রেজাউল করিম
- আবু তাহের
- ছরওয়ার হোসেন
- মো. মিরাজ উদ্দীন
- মামুনুর রশীদ
- ছৈয়দ নূর
- শওকত আলম
- মো. ইলিয়াস
- মো. মারুফুল ইসলাম
- মো. ফারুক
- মো. একরাম
- নূর মোহাম্মদ
মহেশখালীর:
- আজিজুর রহমান
- মোজাম্মেল হক
পেকুয়ার:
- মোহাম্মদ আজিজ
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর:
- মো. হাসান
এ ছাড়া আরো ৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
পরিবারের আকুতি: “আমাদের মানুষগুলোকে ফিরিয়ে দিন”
আটক জেলেদের পরিবার জানায়—
“ট্রলারসহ সবাইকে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ফ্রেজারগঞ্জ থানায় রাখা হয়েছে। আমরা শুধু চাই তারা নিরাপদে দেশে ফিরে আসুক।”
বাঁশখালীর শীলকূপ এলাকার জেলেদের স্বজনরা কাঁদতে কাঁদতে জানান—
“মাছ ধরতে গিয়ে যে এমন বিপদে পড়বে, তা কখনো ভাবিনি। কুয়াশা থাকলে সাগরে গিয়েও বিপদে পড়তে হয়—এটি সরকারের জানা উচিত।”
এদিকে কুতুবদিয়ার জেলেসন্তানদের পরিবার বলছে—
“ভারতীয় পুলিশ বলছে, কাগজপত্র অনুযায়ী তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আমরা চাই—মানবিক কারণে যেন দ্রুত তাদের ফেরত পাঠানো হয়।”
ট্রলার মালিক সমিতির প্রতিক্রিয়া
শেখেরখীল ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আবদু শুক্কুর জানান—
“১৪ নভেম্বর সকালে শেখেরখীল ঘাট থেকে ট্রলারটি যাত্রা করে। পরদিন রাতেই আমরা জানতে পারি—২৬ জেলেকে ভারতীয় কোস্টগার্ড আটক করেছে। মাঝি–মাল্লাদের পরিবারের মধ্যে তীব্র দুশ্চিন্তা চলছে।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান—
“বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর এমনভাবে অসংখ্য জেলে ভারতীয় জলসীমায় চলে যায়। দুই দেশের সমন্বয়ে যেন জেলেদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
সদরঘাট নৌ থানার বক্তব্য
চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন—
“বিষয়টি অবহিতকরণ ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জেলেদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া সাধারণত শুরু হয়।”
বঙ্গোপসাগরে পথ হারানো: কেন বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটে? (সংযুক্ত বিশ্লেষণ)
বাংলাদেশি জেলেদের ভারতীয় হাতে আটক হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। প্রতিবছর প্রায় ৩০০–৪০০ জেলে ভারতের জলসীমায় ঢুকে গ্রেফতার হন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
মূল কারণগুলো হলো:
- ঘন কুয়াশা ও গভীর সাগরে নেভিগেশন লাইনের সমস্যা
- ট্রলারে আধুনিক GPS না থাকা
- সাগরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় দিক নির্ণয়ে ব্যর্থতা
- বাংলাদেশ–ভারত জলসীমার সীমান্ত চিহ্ন স্পষ্ট না থাকা
- সাগরে ঝড়–বৃষ্টি হলে ট্রলার ভেসে যাওয়া
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের কয়েকটি নোটিশে বলা হয়েছে—
“যেসব ফিশিং ট্রলারে আধুনিক GPS বা নেভিগেশন সিস্টেম নেই, সেগুলোর ঝুঁকি বেশি।”
সাগরে সীমানা বিভ্রান্তি: এটিই কি সবচেয়ে বড় সমস্যা?
বঙ্গোপসাগরে ‘গভীর সমুদ্র সীমানা রেখা’ খুব স্পষ্ট নয়। কুয়াশা বা রাতের অন্ধকারে জেলেদের চোখে পানি–বাতাস লাগলে দিক নির্ণয় করা আরও কঠিন হয়ে যায়।
ফলে—
বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করা ট্রলারগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়ে।
ভারত সাধারণত এটিকে “অবৈধ অনুপ্রবেশ” হিসেবে ধরে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা: সাধারণত কী করা হয়?
এরকম ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার সাধারণত—
- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে
- আটক জেলেদের তালিকা যাচাই করে
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠায়
- আদালত প্রক্রিয়া শেষ হলে জেলেদের ফেরত আনা হয়
অনেক সময় এসব জেলেকে ২–৩ মাস জেলেও থাকতে হয়, যা পরিবারগুলোর জন্য বড় কষ্টের।
বিশেষজ্ঞ মত: সমুদ্র নিরাপত্তায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে
মেরিন সেফটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“যদি প্রতিটি ট্রলারে GPS, AIS, VHF রেডিও বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে পথ হারানোর ঘটনা ৮০% কমে যাবে।”
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ–ভারত যৌথভাবে জেলে পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা চুক্তি করলে পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।
বাংলাদেশি জেলেদের ভারতীয় হাতে আটক হওয়া শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং দুই দেশের সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ‘এফবি মায়ের দোয়া’ ট্রলারসহ ২৬ জন নিরপরাধ জেলে কুয়াশার মধ্যে ভুলবশত সীমান্ত পেরিয়ে যায়—এমন অভিযোগ তাদের পরিবার ও স্থানীয়দের।
এখন সকলের প্রত্যাশা—
দুই দেশের প্রশাসন মানবিক বিবেচনায় দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনবে।
জেলে পরিবারগুলো অপেক্ষা করছে—কবে তাদের প্রিয় মানুষগুলো নিরাপদে দেশে ফিরবে।
MAH – 13886 I Signalbd.com



