আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাল ভারত। দিল্লি জানাল, তারা বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও প্রত্যর্পণ প্রশ্নে সরাসরি কিছু বলছে না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ও বহুল আলোচিত রায়ের পর কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তারা বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবে। তবে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার বিষয়ে ভারত এখনো কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর জোর
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারতের “ঘনিষ্ঠ ও নিকটতম প্রতিবেশী”, এবং এ দেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে ভারত সব সময়ই সব অংশীজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত।
তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রত্যর্পণ করার আহ্বান জানানো হলেও ভারতীয় বিবৃতিতে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এই বিষয়টিই বর্তমানে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিবরণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, গত বছর জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন, অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং হত্যার নির্দেশ দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে শেখ হাসিনা দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করে যে, সরকারি শক্তি ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল, গুলি ও আকাশ থেকে নজরদারি চালানো হয়েছিল, যার ফলে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শককে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ রায়কে ঘিরে দেশের ভেতর ও বাইরে রাজনৈতিক উত্তেজনা দ্রুত বাড়ছে। কারণ এটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিচারিক ঘটনা।
শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া
রায়ের পরভারত অবস্থানরত শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনি এই রায় মানেন না এবং এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে দাবি করেছেন। তাঁর ভাষ্য, আদালত তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো নিরপেক্ষভাবে বিচার করেনি এবং ঘটনাগুলির প্রকৃত প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়নি।
তিনি আরও দাবি করেন, তার শাসনামলে অর্থনীতি, শিক্ষা, অবকাঠামো ও আঞ্চলিক কূটনীতিতে যেসব উন্নয়ন হয়েছিল, এই বিচার প্রক্রিয়ায় সেগুলো মোটেও বিবেচনায় আনা হয়নি। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, প্রকৃত আইনি পরিবেশ পেলে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন।
প্রত্যর্পণ ইস্যুতে নতুন সংকট
রায় ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক। সরকার বলেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অন্য কোনো দেশে আশ্রয় দেওয়া হলে তা হবে ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী আচরণ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও ভারত এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনা বা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনো অবস্থান নেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই নীরবতা কূটনৈতিক চাপ বা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের অংশ হতে পারে।
রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলো এই রায়কে কেন্দ্র করে নানা বক্তব্য দিচ্ছে; কেউ এটিকে ন্যায়বিচারের পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে, আবার কেউ বলছে, এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়াবে।
আঞ্চলিকভাবে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নজর রাখছে। বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পানি–বণ্টন, অভিবাসনসহ অনেক বিষয় একে ওপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; একদিকে তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান জানায়, অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থ ও আঞ্চলিক ভারসাম্যও রক্ষা করতে চায়।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে
বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: ভারত কি বাংলাদেশের অনুরোধে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করবে, নাকি কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে অপেক্ষা–দেখো নীতি গ্রহণ করবে?
আইনগতভাবে শেখ হাসিনার সামনে আপিল করার সুযোগ রয়েছে, তবে তিনি যেহেতু দেশে নেই, তাই সেই প্রক্রিয়া কীভাবে এগোবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনেকটাই নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপের উপর। রায়ের প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া, সরকারের কৌশল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান—সবকিছুই আগামী দিনগুলোর পথচিত্র নির্ধারণ করবে।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুধু একটি বিচারিক ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতি, কূটনীতি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। ভারতের প্রতিক্রিয়া আপাত শান্ত হলেও প্রত্যর্পণ ইস্যুতে তাদের নীরবতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। সামনে এই পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেবে, তা নির্ভর করছে দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের ওপর।
এম আর এম – ২২৭৩,Signalbd.com



