মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অস্বাভাবিকভাবে জোরদার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এলাকা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল—প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দেখা গেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর টহল ও নজরদারি।
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অশান্তি, বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সব বাহিনী। সকাল থেকেই রাজধানীর প্রধান প্রধান রাস্তা, মোড়, আদালতপাড়া, সরকারি ভবন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও গণপরিবহন কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত চেকপোস্ট বসানো হয়। নাগরিকদের চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও নিরাপত্তা তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।
আদালতপাড়ায় অভূতপূর্ব নিরাপত্তা প্রস্তুতি
সুপ্রিম কোর্টের চারপাশ যেন একেবারে নিরাপত্তার বলয়ে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একাধিক প্রবেশপথ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশাল জলপাই-সবুজ পোশাকের সেনাসদস্যদের কোর্টের মূল গেটের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তাদের পাশাপাশি রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট—পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চারদিকে গোয়েন্দা নজরদারির জন্য অতিরিক্ত সিসিটিভি স্থাপন এবং কন্ট্রোল রুম থেকে প্রতিটি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলায় বিশেষ রিজার্ভ ফোর্স প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানা গেছে।
হাইকোর্ট-মাজার গেট এলাকা, বার ভবন, আইনজীবীদের পার্কিং জোন—সব জায়গায় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে অধিক সংখ্যক ইউনিফর্মধারী ও সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আদালতপাড়ায় প্রবেশের সময় আইনজীবী, সাংবাদিক, স্টাফসহ সকলের পরিচয় নিশ্চিত করে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
সড়ক বন্ধ, চেকপোস্ট, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ
রাজধানীর দোয়েল চত্বর থেকে শুরু করে শিক্ষাভবন অভিমুখী সড়ক পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এ এলাকা দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনাল সংলগ্ন বিভিন্ন গলিপথ ও সংযোগ সড়কেও।
পুলিশ জানিয়েছে, রায়কে কেন্দ্র করে কোনো সংঘাত বা ঝুঁকির সম্ভাবনা এড়াতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪৫টির মতো অতিরিক্ত চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ও সন্দেহজনক যাত্রীদের থামিয়ে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বিশেষ করে আদালতপাড়া, সচিবালয়, আগারগাঁও প্রশাসনিক অঞ্চল, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা এবং গুলশান-বনানী কূটনৈতিক অঞ্চলে নজরদারি কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে। এসব এলাকায় উঁচু ভবনের ছাদেও স্নাইপার দল মোতায়েন রাখা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর মধ্যেও রাজধানীতে স্বাভাবিক জনজীবন
অস্বাভাবিক নিরাপত্তা সত্ত্বেও রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় মানুষের স্বাভাবিক চলাচল দেখা গেছে। সকালে অফিসপাড়ায় ভিড় জমে, মেট্রোরেল স্বাভাবিকভাবে চলেছে, গণপরিবহনেও ছিল যাত্রীসমাগম।
তবে নিরাপত্তা তৎপরতা দৃশ্যমান হওয়ায় অনেক নাগরিকের মনে কিছুটা উৎকণ্ঠা দেখা গেলেও উদ্বেগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। দোকানপাট, বাজার, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও স্বাভাবিকভাবেই চলেছে।
ডিএমপির এক অতিরিক্ত কমিশনার বলেন—
“আমরা নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো বাধা দিতে চাই না। তবে রায়কে ঘিরে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, রায় ঘোষণার আগে-পরে ভুয়া তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে সাইবার ইউনিটও তৎপর রয়েছে।
মামলার আসামি ও অভিযোগসমূহ — বিস্তৃত প্রেক্ষাপট
গত বছরের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এই মামলাটি গঠিত হয়। এই মামলার তিন আসামি হলেন—
- শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী
- আসাদুজ্জামান খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
- চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি
এদের মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুনই একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামি। তিনি ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে। অপর দুই আসামি পলাতক।
প্রসিকিউশনের আনা মোট পাঁচটি অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়—
১️⃣ ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য
প্রসিকিউশন দাবি করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রাক্কালে দেওয়া সেই বক্তব্য দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়েছিল।
২️⃣ আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ
হেলিকপ্টার, ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ‘নির্মূল’ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
৩️⃣ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা
আন্দোলন চলাকালীন রংপুরে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৪️⃣ ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা
চানখাঁরপুলের ওই ঘটনার ভিডিও ও স্থলচিত্র আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন।
৫️⃣ আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা
মহাসড়কে সহিংস পরিস্থিতির সময় এই অগ্নিসংযোগে নিহতের ঘটনাটিকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আনা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রস্তুতি ও রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ
গত ১৩ নভেম্বর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিনটি নির্ধারণ করেন। প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন—
- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ
- বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী
এর আগেই, গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়। পরে ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন সম্পন্ন হয়।
আইনি বিশ্লেষকদের মতে, মামলাটি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন, কারণ এখানে অভিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো রায়কে ঘিরে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
রায় ঘোষণার আগের দিন থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠন এ রায়ের ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে—
রায় ঘোষণার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা দূর হবে। তারা স্বচ্ছ তদন্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের আশা করছে।
শাসক দলের নেতারা বলছেন—
এটি সম্পূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়া, রাজনীতি নয়। কিন্তু রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের উসকানি বা অরাজকতা বরদাশত করা হবে না।
সাধারণ মানুষ
অনেকেই মনে করেন দেশের স্থিতিশীলতার জন্য আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি। তারা সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
রাজধানীতে নিরাপত্তা— প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারিও বেড়েছে
সিসিটিভি নেটওয়ার্ক, মোবাইল প্যাট্রোল, ড্রোন নজরদারি, রিয়েল-টাইম মনিটরিং সেল—সব মিলিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার এবার বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর ও কূটনৈতিক অঞ্চলে ফেস-রেকগনিশন ক্যামেরাও সক্রিয় রয়েছে।
যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সম্ভাব্য পাঁচ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আলাদা কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—
- জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ
- যান চলাচল ব্যবস্থাপনা
- অগ্নিসংযোগ বা ভাঙচুর প্রতিরোধ
- দ্রুত উদ্ধার অভিযান
- মেডিকেল রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখা
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন—
“রায়কে কেন্দ্র করে কেউ যদি পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সব মিলিয়ে রাজধানীতে সতর্কতার আবহ
সকাল থেকে রাতে ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টার টহলের শব্দ শোনা যায়। গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে অস্ত্রধারী বাহিনীর উপস্থিতি, পুলিশ ভ্যান, টহল গাড়ি—সব মিলিয়ে শহরজুড়ে এক সতর্কতার পরিবেশ তৈরি হয়।
তবে এর মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় বাধা দেখা যায়নি—এটাই স্বস্তির জায়গা।
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে নতুন অধ্যায় যোগ করতে যাচ্ছে। রায় যাই হোক, সেই রায়ের আগে রাজধানী ঢাকাকে নিরাপত্তার শক্ত বলয়ে আবদ্ধ করা হয়েছে, যাতে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ থাকে।
MAH – 13837 I Signalbd.com



