বাংলাদেশ

লিবিয়া উপকূলে ২৬ বাংলাদেশিকে নিয়ে নৌকাডুবি, ৪ জনের মৃত্যু

Advertisement

উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার উপকূলে ২৬ বাংলাদেশি নাগরিককে বহনকারী একটি নৌকা ডুবে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। একই সময় আরও একটি নৌকা ডুবে অর্ধশতাধিক সুদানি ও মিসরীয় অভিবাসী ঝুঁকিতে পড়েছিলেন। যদিও দ্বিতীয় নৌকার যাত্রীরা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু প্রথম নৌকায় থাকা বাংলাদেশের চার নাগরিকের মৃত্যু আবারও মানবপাচার, ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রা এবং ইউরোপমুখী অভিবাসন সংকটকে সামনে এনে দিয়েছে।

লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আল-খোমস উপকূলে বৃহস্পতিবার রাতে এই দুটি নৌকাডুবি ঘটে। পরদিন স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট উদ্ধার অভিযান শুরু করে এবং মরদেহ উদ্ধার নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড, আলজাজিরা, এপি নিউজ ও স্থানীয় আরাধনা সংবাদপোর্টালগুলো একাধিক প্রতিবেদনে ঘটনাটি জানিয়েছে।

নৌকায় ছিলেন ২৬ জন বাংলাদেশি—মৃত চারজন, বাকিদের খোঁজ চলছে

লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট জানায়, প্রথম নৌকাটিতে বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন ২৬ জন। আল-খোমস উপকূলের কাছে নৌকাটি ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে গেলে যাত্রীরা সমুদ্রে পড়ে যান। উদ্ধারকর্মীরা রাতভর অভিযান চালিয়ে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেন এবং বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করেন।

তবে নৌকার সব যাত্রীর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) কাজ করছে।

বাংলাদেশ দূতাবাস (লিবিয়ার ত্রিপোলি মিশন) প্রবাসী বাংলাদেশিদের তালিকা যাচাই করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

দ্বিতীয় নৌকায় ছিলেন ৬৯ জন—বেশিরভাগই সুদানি

লিবিয়ার একই উপকূলে আরও একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। এই নৌকাটিতে ছিলেন ৬৯ জন অভিবাসী—যাদের মধ্যে ৬৭ জন সুদানিস এবং দুজন মিসরীয় নাগরিক। তাদের মধ্যে আটজন শিশু ছিল।

সৌভাগ্যবশত এই নৌকাডুবিতে কেউ মারা যায়নি। উদ্ধারকারী দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারায় তারা সকলকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

কেন লিবিয়ায় বারবার এমন ট্র্যাজেডি ঘটছে?

লিবিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপমুখী অভিবাসীদের জন্য অন্যতম প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর দেশটি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীর দখলে বহু উপকূলীয় এলাকা চলে যায়।

যে কারণে—

  • মানবপাচারকারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করছে
  • উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সরকারি নজরদারি কম
  • অভিবাসীদের ধরে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে
  • অভিবাসীদের বিপজ্জনক, ভাঙ্গাচোরা নৌকায় তুলে ভূমধ্যসাগরে পাঠানো হচ্ছে

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৮ লাখের বেশি অবৈধ অভিবাসী লিবিয়ায় অবস্থান করছে। তাদের বেশিরভাগই ইউরোপে চলে যাওয়ার অপেক্ষায়।

বাংলাদেশিরা কেন এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে যায়?

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি বড় অংশ লিবিয়ার মাধ্যমে ইতালি, মাল্টা বা দক্ষিণ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বিশেষজ্ঞরা এর কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন—

১. দালালচক্রের প্রলোভন

তারা গ্রামাঞ্চলের মানুষকে স্বপ্ন দেখায়—
“ইতালিতে পৌঁছালে মাসে লাখ টাকা আয় করতে পারবেন।”
এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকে ৩–৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে দেন দালালদের হাতে।

২. সরাসরি ইউরোপ ভিসা পাওয়া কঠিন

ইউরোপীয় দেশগুলো কঠোর ভিসানীতি অনুসরণ করায় বৈধ পথে যাওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে অবৈধ রুটই অনেকের শেষ ভরসা হয়ে ওঠে।

৩. লিবিয়ার নিরাপত্তাহীন পরিবেশে অভিবাসীরা অসহায়

লিবিয়ায় স্থায়ী সরকার না থাকায় অনেকের পাসপোর্ট, টাকা, মালপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে তারা চাইলেও আর দেশে ফিরতে পারে না।

৪. দারিদ্র্য ও বেকারত্ব

গ্রামে কৃষিকাজ, ছোট চাকরি বা ঐতিহ্যবাহী পেশায় জীবিকা কষ্টকর হওয়ায় তরুণরা ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়।

ভূমধ্যসাগর—বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্র রুট

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) জানায়, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজারের বেশি মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে।
২০২৩ সালে মারা যায় অন্তত ৩,০০০+ অভিবাসী
২০২৪ সালে সংখ্যাটি আরও বেড়ে যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী অভিবাসন রুট।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা লিবিয়া কর্তৃপক্ষ ও তাদের কোস্টগার্ডের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তুলেছে—

  • আটককৃত অভিবাসীদের নির্যাতন
  • নারীদের যৌন নির্যাতন
  • মুক্তিপণের জন্য জিম্মি করে রাখা
  • পাচারকারীদের সঙ্গে অঘোষিত সমঝোতা
  • টাকা ছাড়া কাউকে ছেড়ে না দেওয়া

ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়া কোস্টগার্ডকে সরঞ্জাম ও অর্থসহায়তা দিলেও, এর অপব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকার গত কয়েক বছর ধরে মানবপাচার রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে—

  • লিবিয়ায় আটকে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা
  • মানবপাচারের মামলায় শতাধিক দালাল-এজেন্ট গ্রেপ্তার
  • অভিবাসী সচেতনতা বাড়াতে দেশব্যাপী ক্যাম্পেইন
  • বৈধ পথে বিদেশযাত্রাকে সহজ করা

তবুও দালালচক্রের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।

এই ঘটনার পরও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইউরোপে এখন অভিবাসন কমে গেলেও বিপদ বেড়েছে

ইউরোপীয় দেশগুলো গত কয়েক বছর ধরে তাদের সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন কমিয়ে দিয়েছে। এতে সমুদ্রে বিপদে পড়া নৌকাগুলো আগে যেমন দ্রুত উদ্ধার পেত, এখন আর তেমনটি হয় না।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে—

  • “সমুদ্রযাত্রা এখন আগের চেয়ে দ্বিগুণ বিপজ্জনক।”

এছাড়া দাতব্য সংস্থার রেস্কিউ জাহাজগুলোও নানা আইনি জটিলতার মুখে পড়ে কাজ করতে পারছে না।

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংঘাত—অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে

সুদানে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। ইথিওপিয়া, নাইজার, চাদ, সোমালিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া—সব জায়গায় অস্থিরতা চলছে।
ফলে লাখ লাখ মানুষ ইউরোপে পালাতে চাইছে।

বাংলাদেশ থেকেও তরুণরা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়ায় পা দেন, এবং পরে পাচারকারীদের মাধ্যমে সাগর পথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশির নৌকাডুবি—তাদের গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়া

মৃত চারজনের পরিচয় এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, তারা দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।
পরিবারগুলো খবর পেয়ে শোকে অধীর হয়ে আছে। অনেকেই জানতেন না যে তাদের প্রিয়জন সমুদ্রপথে যাচ্ছেন।

অনেকে ফোন করে জানিয়েছে—
“দালাল বলেছিল, নিরাপদে পৌঁছাবে। এখন তো সব শেষ।”

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল কামরুল বলেন—
“লিবিয়া এখন আর নিরাপদ দেশ নয়। এই পথটি বন্ধ না হলে বাংলাদেশিদের মৃত্যু থামবে না। দালালচক্র ভেঙে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

অভিবাসন গবেষক তৌহিদুল ইসলাম বলেন—
“ইউরোপমুখী অভিবাসনের স্বপ্নই তাদের মূল টান। কাজেই বৈধ উপায়ে কর্মসংস্থানের দরজা বাড়াতে হবে।”

পরিবারগুলো কী করতে পারে?

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—

  • নিখোঁজদের বিষয়ে পরিবারদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে
  • মৃতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে
  • জীবিতদের নিয়ে কাজ চলছে

পরিবারগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—

  • অজ্ঞান দালালদের কথা বিশ্বাস না করতে
  • কেউ লিবিয়ায় গেলে মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে

ইউরোপে যাওয়ার বৈধ ও নিরাপদ পথ আছে—বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

বাংলাদেশিরা চাইলে নিচের বৈধ পথগুলো ব্যবহার করতে পারে—

  • স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা
  • স্টুডেন্ট ভিসা
  • জব স্পন্সর ভিসা
  • ব্লু-কার্ড ইউ
  • বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে কাজ

সমুদ্রপথে অবৈধ যাত্রা এখন প্রায় মৃত্যুর সমান ঝুঁকিপূর্ণ।

লিবিয়া উপকূলে ২৬ বাংলাদেশিকে নিয়ে ঘটানো নৌকাডুবি আবারও প্রমাণ করে—অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন কতটা বিপজ্জনক। চারজন বাংলাদেশির মৃত্যু দেশের হাজারো পরিবারের স্বপ্নকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। মানবপাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থাকে সহজ করা ছাড়া এই মৃত্যুমিছিল থামানো অসম্ভব।

MAH – 13816 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button