সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণে মাছ শিকার করতে গিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দুটি ট্রলারসহ ১৩ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। ঘটনাটির পর থেকে উপকূলজুড়ে জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত
বুধবার (১২ নভেম্বর) বিকালে বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ উপকূলে এ ঘটনা ঘটে। টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ জানিয়েছেন, সকালে দুইটি ট্রলার মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে সাগরে যায়। দুপুরের দিকে একটি ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়লে হঠাৎই মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির সদস্যরা ধাওয়া করে উভয় ট্রলারসহ ১৩ জন মাঝিমাল্লাকে ধরে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, “আমার ঘাটের দুটি ট্রলার সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণে পৌঁছালে আরাকান আর্মি তাদের ধাওয়া দেয়। পরে উভয় ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে তারা ধরে নিয়ে যায়। ঘটনাটির পর থেকেই ট্রলার মালিক ও জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
তল্লাশি ও প্রাথমিক তদন্ত
এ বিষয়ে টেকনাফস্থ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, “ট্রলারসহ কিছু জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা খবর পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কোনো বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সরকারি প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনায় দ্রুত তদন্ত শুরু করা হয়েছে এবং জেলেদের উদ্ধারে বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে অবহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে উপকূলজুড়ে নৌযান চলাচলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের দাবি
মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল আরাকান নেটওয়ার্ক’ জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর থেকে আরাকান আর্মির উপকূলীয় নিরাপত্তা শাখা সমুদ্রপথে টহল জোরদার করেছে। তাদের দাবি, বাংলাদেশের জেলেরা নিয়মিতভাবে রাখাইন রাজ্যের জলসীমা অতিক্রম করে মাছ শিকার করছে। এ কারণে টহল ইউনিটগুলো “অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের” আটক করছে।
সংবাদমাধ্যমটি আরও জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৮৮ বাংলাদেশি জেলে ও ৩০টি নৌকা আটক করার পর মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে অভিযান শুরু হয়েছে।
জেলেদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক
আটক জেলেদের পরিবারগুলোর মধ্যে এখন চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার এক জেলের স্ত্রী বলেন, “প্রতিদিনই ভয় পাই, কখন কী হয়। আজ আমার স্বামীও গেছে সাগরে। এখন শোনছি আবার জেলেদের ধরে নিয়ে গেছে। আমরা চাই সরকার দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনে।”
ট্রলার মালিক মো. সৈয়দ আলম বলেন, “আরাকান আর্মির কারণে নাফ নদী ও সাগরে মাছ ধরা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। সরকারের জরুরি পদক্ষেপ না এলে জেলে ও মালিকদের দুর্দিন নেমে আসবে।”
পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি
নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে জেলে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে গত ৬ নভেম্বর নাফ নদীর বদরমোকাম এলাকা থেকে ছয় বাংলাদেশি জেলেসহ একটি ট্রলার ধরে নিয়ে যায় একই সংগঠন।
ট্রলার মালিক ও বিজিবির তথ্যমতে, গত ১১ মাসে অন্তত ৩২৮ বাংলাদেশি জেলেকে আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের প্রচেষ্টায় ১৮৯ জনকে মুক্ত করা গেলেও এখনো অন্তত ১৫০ জনেরও বেশি জেলে মিয়ানমারের কারাগারে আটক আছেন।
স্থানীয় প্রশাসনের অবস্থান
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে। জেলেদের উদ্ধারে বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে জটিল হয়ে উঠেছে। তাই জেলেদের অনুরোধ করছি, নির্ধারিত সীমার বাইরে মাছ ধরতে না যেতে।”
মতামত
কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মজিবুর রহমান মনে করেন, “আরাকান আর্মির সঙ্গে চলমান সংঘাতের কারণে মিয়ানমারের সীমান্ত ও উপকূলীয় অঞ্চলগুলো অস্থিতিশীল। এই অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।”
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ বাড়িয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো। একই সঙ্গে সীমান্তে কোস্টগার্ড টহল আরও জোরদার করা দরকার।”
সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ
ঘটনার পর বিজিবি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী যৌথভাবে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যমে আটক জেলেদের ফেরত আনার চেষ্টা চলছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি এই ধরনের ঘটনা চলতেই থাকে, তাহলে উপকূলীয় অর্থনীতি এবং স্থানীয় মাছশিকারি সম্প্রদায় বড় ধরনের সংকটে পড়বে।
সেন্ট মার্টিন উপকূলে জেলেদের নিরাপত্তা এখন বড় প্রশ্ন। প্রশাসনের তদন্ত ও উদ্ধার অভিযান চলছে, কিন্তু পরিবারগুলোর অপেক্ষা একটাই — প্রিয়জনেরা যেন নিরাপদে ফিরে আসেন।
এম আর এম – ২২০৩,Signalbd.com



