বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এমন সময়েই কানাডার একটি উচ্চপর্যায়ের সংসদীয় প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে সাক্ষাৎ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।
বুধবার (১২ নভেম্বর ২০২৫) রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এ সাক্ষাতে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের জনগণ এখন নতুন দিগন্তে পদার্পণ করতে প্রস্তুত।”
সাক্ষাতে উপস্থিত ছিলেন কানাডীয় সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান–এর নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে উভয় দেশ রোহিঙ্গা সংকট, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং মানবিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে।
বাংলাদেশের রূপান্তরের মুহূর্ত
ড. ইউনূস বৈঠকে বলেন, “আপনারা এমন সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যখন দেশটি এক ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে একটি নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা এখন পরিবর্তনের দিকে।”
তিনি জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এই প্রক্রিয়ার মাইলফলক হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
“আমরা চাই এই নির্বাচন হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য। জনগণ যেন তাদের প্রতিনিধি নিজেরাই বেছে নিতে পারে, সেটিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য,”—যোগ করেন ড. ইউনূস।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ ও কানাডার প্রতিশ্রুতি
সাক্ষাতে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল রোহিঙ্গা সংকট, যা বাংলাদেশের জন্য এখনো বড় মানবিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
ড. ইউনূস বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট এখন আট বছর পার করেছে। প্রায় ১২ লাখ মানুষ আশ্রিত রয়েছেন কক্সবাজার ও ভাসানচরে। এখানে নতুন প্রজন্মের হাজারো শিশু জন্ম নিচ্ছে, বড় হচ্ছে—কিন্তু তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী। তাদের হতাশা ও অনিশ্চয়তা আমাদের জন্যও গভীর উদ্বেগের বিষয়।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে, মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনই একমাত্র টেকসই সমাধান। আন্তর্জাতিক সহায়তা ক্রমেই কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে বলে তিনি সতর্ক করেন।
কানাডীয় সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান এ সময় বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সমস্যা। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কথা বলছি এবং কানাডা এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকবে।”
তিনি জানান, কানাডার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তিনি আবারও বক্তব্য দেবেন এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার পক্ষে জোর দেবেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন দিগন্ত
বৈঠকে বাংলাদেশ-কানাডা বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করার বিষয়ে দুই পক্ষই আগ্রহ প্রকাশ করে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বেশিরভাগ অংশই তৈরি পোশাক খাতে।
কানাডীয় সংসদ সদস্য সামির জুবেরি, যিনি বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক মন্ত্রীর সংসদীয় সচিব, বলেন—“আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বৈচিত্র্যময় করতে চাই। শুধু পোশাক নয়, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতেও সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এশিয়া সফরে গিয়েছিলেন নতুন বাণিজ্যিক অংশীদার খোঁজার উদ্দেশ্যে, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি উদ্ভাবনী, রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলা। কানাডার অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি আমাদের সেই পথে অনেক সহায়তা করতে পারে।”
উপস্থিত প্রতিনিধি ও আলোচ্য বিষয়সমূহ
প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন:
- সালমা জাহিদ, কানাডার সংসদ সদস্য (স্কারবোরো সেন্টার–ডন ভ্যালি ইস্ট, লিবারেল দল)
- মাহমুদা খান, হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল (এইচসিআই)-এর গ্লোবাল সিইও
- মাসুম মাহবুব, হিউম্যান কনসার্ন ইউএসএ (এইচসিইউএসএ)-এর সিইও
- আহমদ আতিয়া, জেস্টাল্ট কমিউনিকেশনসের সিইও
- উসামা খান, ইসলামিক রিলিফ কানাডার সিইও
বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং এসডিজি–বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ।
আলোচনায় উভয় পক্ষ পোশাক, কৃষি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে একমত হন। বিশেষত, বাংলাদেশের কৃষি প্রযুক্তি ও বস্ত্রশিল্পে কানাডার বিনিয়োগ বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
ড. ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নির্বাচনী আচরণবিধি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা—সব ক্ষেত্রেই সংস্কার চলছে।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু নির্বাচন আয়োজন নয়, বরং এমন একটি কাঠামো গড়ে তোলা, যাতে ভবিষ্যতের সরকার জনগণের প্রতি জবাবদিহি থাকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আমরা নতুন ভিত্তিতে দাঁড় করাতে চাই।”
কানাডীয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের এ প্রচেষ্টার প্রশংসা করে এবং ভবিষ্যত সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানবিক বাস্তবতা
আলোচনার বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ড. ইউনূস বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক সহায়তা আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কমে গেছে। হাজারো পরিবার খাদ্য ঘাটতি ও শিক্ষার অভাবে ভুগছে।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি শুধু মানবিক নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে।”
সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজানও একমত হন, “রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তায় রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হতে হবে।”
বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্কের নতুন অধ্যায়
বাংলাদেশ ও কানাডা দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই কানাডা বাংলাদেশের পাশে থেকেছে বিভিন্ন মানবিক ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে।
বর্তমানে কানাডা বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং মানবিক দাতা দেশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী উন্নয়ন ও শরণার্থী সহায়তায় কানাডার অবদান বিশেষভাবে প্রশংসিত।
ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি এক মানবিক সম্পর্ক। আমরা একসঙ্গে উন্নয়ন ও মানবতার পথে এগিয়ে যেতে চাই।”
আগামী দিনের প্রত্যাশা
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা ও কানাডীয় প্রতিনিধিদল উভয়েই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের লক্ষ্য এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে, বিভাজিত নয়। দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়, আমরাও সেই পরিবর্তনের সঙ্গী।”
কানাডীয় সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাবে। কানাডা সবসময় সেই যাত্রায় অংশীদার থাকবে।”
বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল অথচ সম্ভাবনাময় সময় অতিক্রম করছে। নির্বাচন, সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সবকিছু মিলিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ নতুন রূপ নিচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সেই রূপান্তরের পথনকশা তৈরি করছে, যেখানে গণতন্ত্র, মানবিকতা ও উন্নয়ন একই সুরে মিলিত হচ্ছে। কানাডীয় প্রতিনিধিদলের এই সফর দুই দেশের পারস্পরিক বন্ধন ও সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
MAH – 13773 I Signalbd.com



