বাংলাদেশ

মানব পাচারের ফাঁদে পড়ে রাশিয়ায়, যশোরের জাফরের যুদ্ধের করুণ গল্প

যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া সরদারপাড়ার বাসিন্দা জাফর হোসেন (৩২) জীবনের উন্নতির আশায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি এখন রাশিয়ায় ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। জাফরের বাবা খায়রুল সরদার গত সোমবার এ তথ্য জানিয়েছেন।

বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ও প্রতারণার শুরু

প্রায় পাঁচ মাস আগে ঢাকার একটি এজেন্সির মাধ্যমে সাইপ্রাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন জাফর। এর জন্য তিনি ৯ লাখ টাকা দেন। কিন্তু দালালের প্রতারণার কারণে প্রথমে তাকে সৌদি আরবে দুই মাস থাকতে হয়। এরপর দুবাই, তুরস্ক হয়ে রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে তাকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হয়।

পরিবারের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা

জাফর মোবাইল ফোনে এই দুঃসংবাদটি তার পরিবারকে জানান। এতে তার মা হাসিনা খাতুন ও স্ত্রী খাদিজা খাতুন গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। জাফরের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। পরিবারটি যেকোনো মূল্যে জাফরকে ফিরে পেতে চান এবং পাচারকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

মানব পাচারের বিস্তৃতি ও অন্যান্য ভুক্তভোগীর গল্প

জাফরের ঘটনা একক নয়। সম্প্রতি চ্যানেল ২৪-এর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কাজের প্রলোভন দেখিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশিদের ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে। নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবির ও তার দুলাভাই রহমত আলী সংসারের সচ্ছলতার আশায় রাশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে চাকরির নামে তাদের যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এই যুদ্ধে হুমায়ুন কবির প্রাণ হারিয়েছেন।

এছাড়া, রাজবাড়ীর আরমান মণ্ডল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। তিনি জানান, ইউক্রেনের ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে আক্রান্ত হন।

মানব পাচার প্রতিরোধে করণীয়

বাংলাদেশে মানব পাচার একটি গুরুতর সমস্যা। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে ৫৮০টি যৌন পাচারের এবং ৬,৩৭৮টি শ্রম পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

U.S. Embassy Dhaka Seal

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও দালালদের প্রলোভন থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাফর হোসেনের করুণ গল্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানব পাচারের ভয়াবহতা। বিদেশে কাজের আশায় প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই জীবন বিপন্ন করছেন। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে, বিদেশে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত। এছাড়া, যারা ইতোমধ্যে এই ফাঁদে পড়েছেন, তাদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

জাফরের পরিবার ও অন্যান্য ভুক্তভোগীদের প্রতি আমাদের সমবেদনা রইল। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনবে এবং দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মানব পাচার প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সন্দেহজনক কার্যক্রম সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হবে। এভাবে আমরা একটি নিরাপদ ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

জাফরের মতো আর কেউ যেন এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার না হন, সেই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button