এলসি ও ব্যাংক ঋণের জালিয়াতি, পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে শীর্ষ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা অনুমোদনের পথে
বাংলাদেশের প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও অর্থ পাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত তদন্ত শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
মামলার পটভূমি
দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে জালিয়াতির আশ্রয়ে একাধিক গার্মেন্টস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আত্মসাৎ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালকদের সঙ্গে সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে তদন্তে জানা গেছে।
দুদক জানিয়েছে, এ ঘটনায় পাঁচটি মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় মোট ৩৪ জনকে আসামি করা হচ্ছে। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সালমান এফ রহমান, তার ছেলে শায়ান এফ রহমান, ভাই সোহেল এফ রহমান, সোহেল রহমানের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানসহ বেক্সিমকো গ্রুপের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং জনতা ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিস্তারিত ও অর্থের পরিমাণ
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আসামিদের যোগসাজশে জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এলসি খোলার সময় জাল নথিপত্র ও মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে এই লেনদেন সম্পন্ন করা হয়।
দুদকের হিসাব অনুযায়ী, মোট আত্মসাত করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ২১ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার সমান।
এই অর্থ পাচারের প্রক্রিয়ায় পিয়ারলেস গার্মেন্টস, প্লাটিনাম গার্মেন্টস, কাঁচপুর অ্যাপারেলস, স্কাইনেট অ্যাপারেলস ও নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভুয়া রপ্তানির এলসি তৈরি করে বৈদেশিক ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়।
সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক কর্মকর্তারা
দুদকের মামলার খসড়ায় দেখা গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তাও এই দুর্নীতির ঘটনায় জড়িত ছিলেন। জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ, আবদুল জব্বার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান, উপমহাব্যবস্থাপক আবদুর রহিমসহ অন্তত ১২ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে সম্ভাব্য আসামির তালিকায়।
তদন্তে আরও জানা গেছে, এই কর্মকর্তারা জালিয়াতিপূর্ণ এলসির অনুমোদন দেন এবং অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়ায় সরাসরি সহায়তা করেন।
রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাব
সালমান এফ রহমান দীর্ঘদিন ধরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই মামলা শুধু একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নয়, বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কেও এর প্রভাব পড়তে পারে। এটি দেশের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের একটি বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তদন্তের বর্তমান অবস্থা
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মামলাগুলোর প্রাথমিক তদন্ত শেষ হয়েছে। ব্যাংক লেনদেন, বিদেশি মুদ্রা প্রবাহ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে অর্থের উৎস ও গন্তব্য চিহ্নিত করা হচ্ছে।
মামলাগুলোর চার্জশিট দাখিলের পর পরবর্তী ধাপে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলাগুলো প্রমাণ করে যে দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, যা অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি।
তাদের মতে, এই মামলা শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, বরং আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই আত্মসাত মামলা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে বড় করপোরেট দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক শক্ত বার্তা হয়ে দাঁড়াবে।
তবে এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তদন্ত শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে আদালত কী রায় দেবে। আপাতত দেশের জনগণ ও ব্যবসায়ী মহল অপেক্ষায় রয়েছে—দুদক কি সত্যিই বড় প্রভাবশালীদেরও আইনের আওতায় আনতে পারবে?
এম আর এম – ২০৭৬,Signalbd.com



