ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে এই তালিকা প্রকাশ করেন। ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি এবার দিনাজপুর-৩, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা সভা ও নেতৃত্বের উপস্থিতি
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকেল থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। বৈঠকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, প্রার্থী তালিকা এবং নির্বাচনী কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দীর্ঘ এই বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সংবাদ সম্মেলনে ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন।
ঘোষণার সময় তিনি জানান, “যেসব আসনের বিষয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে, সেগুলোর নাম পরবর্তী ধাপে জানানো হবে। পাশাপাশি শরিক দলগুলোর জন্য কিছু আসন খালি রাখা হবে।”
বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। এবার তার তিন আসনে প্রার্থী হওয়া শুধু একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বিএনপির জন্য একটি প্রতীকী বার্তা — দলীয় ঐক্য, নেতৃত্বের স্থায়িত্ব এবং ভোটারদের আস্থার প্রতিফলন।
এবারও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখে তিনি দিনাজপুর-৩, বগুড়া-৭ এবং ফেনী-১ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তিনটি আসনই ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, এবং সেখানে খালেদা জিয়ার নামই ভোটারদের মধ্যে শক্ত বার্তা পাঠাবে।
তারেক রহমানও মাঠে: বগুড়া-৬ আসন থেকে লড়বেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
এই প্রথমবারের মতো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনী ময়দানে নামছেন। তিনি বগুড়া-৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণায় জানানো হয়েছে। দলীয় নেতারা মনে করছেন, বগুড়ায় একযোগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রার্থীতা দলের তৃণমূল সংগঠনকে উজ্জীবিত করবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেও ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছেন। দলের অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন—মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), মির্জা আব্বাস (ঢাকা-৮), সানজিদা ইসলাম তুলি (ঢাকা-১৪), এবং আমান উল্লাহ আমান (ঢাকা-২)।
দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়ার সক্রিয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন
শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেগম খালেদা জিয়া সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে ছিলেন। দলের পক্ষ থেকে তাকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রতীকী উপস্থিতি হিসেবে রাখা হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে নানা জল্পনা ছিল।
এবারের ঘোষণা সেই জল্পনার অবসান ঘটিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, “খালেদা জিয়ার নামেই বিএনপির রাজনীতির প্রাণশক্তি। তার প্রার্থীতা মানে মাঠে মনোবল দ্বিগুণ।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার তিন আসনে প্রার্থী হওয়া আসলে তার রাজনৈতিক পুনরাগমনের ঘোষণা, যা দলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
বিএনপির এই ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার মন্তব্য অনুযায়ী, “এটি একটি রাজনৈতিক নাটক, বাস্তবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।”
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এটি দলের ভবিষ্যতের লড়াইয়ের সূচনা। এক সিনিয়র নেতা বলেন, “আমরা গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই করছি। খালেদা জিয়া এই সংগ্রামের প্রতীক।”
বিশ্লেষকদের মতে, তিনটি আসনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের ঘোষণা শুধু প্রার্থিতা নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তা—“বিএনপি এখনো মাঠে, এবং নেতৃত্ব এখনো দৃঢ়।”
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও পরবর্তী ধাপ
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপি আগেভাগেই প্রার্থীদের মাঠে নামাচ্ছে, যাতে সংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে পারে। দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রার্থীকে স্থানীয় পর্যায়ে গণসংযোগ, ভোটার সংলাপ ও প্রচারণার প্রস্তুতি শুরু করতে বলা হয়েছে।
বিএনপির পুনর্জাগরণের সূচনা?
দলীয় সূত্র বলছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি “কৌশলগত পুনর্গঠন” নীতি অনুসরণ করছে। এর অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, স্থানীয় জোট গঠন এবং জনমত জরিপের কাজ চলছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের একসঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দলের জন্য ঐক্যের প্রতীক হতে পারে। তবে বাস্তবতা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, ভোটের পরিবেশ এবং সরকারের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
বেগম খালেদা জিয়ার তিন আসনে প্রার্থীতা ঘোষণা নিঃসন্দেহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি যদি সরাসরি নির্বাচনী ময়দানে অংশ নিতে পারেন, তবে তা হবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। এখন পুরো দেশের দৃষ্টি নির্বাচনী তফসিল ও পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপের দিকে।
এম আর এম – ২০৭৪,Signalbd.com



