বাংলাদেশ

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১১৬২

Advertisement

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, আর নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১৬২ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৮৩ জন।

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ ও নভেম্বরের শুরুতে রোগীর সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন করে ১১৬২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার (১ নভেম্বর) সকাল ৮টা থেকে রোববার (২ নভেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১১৬২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩৬ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগে ৭২৬ জন। বিভাগভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, বরিশালে ১৬৩ জন, চট্টগ্রামে ১০৮ জন, খুলনায় ১৫৪ জন, ময়মনসিংহে ৮৭ জন, রাজশাহীতে ৯৮ জন, রংপুরে ৩২ জন এবং সিলেটে ৮ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৭১ হাজার ৬৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৯ হাজারের বেশি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তবে ২৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ঢাকা এখনো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা

যদিও ডেঙ্গু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তবুও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকাতেই। রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো, যেমন মিরপুর, ধানমন্ডি, বাসাবো, মুগদা, রমনা ও যাত্রাবাড়ী — এ অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশই এর মূল কারণ। জমে থাকা পানি, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া মিলিয়ে মশা দমনে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় সংক্রমণ বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা ও পরামর্শ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন মৌসুমি নয়; এটি সারা বছরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম দুর্বল হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে আসা রোগীদের অনেকেই জটিল অবস্থায় ভর্তি হচ্ছেন। প্লেটলেট কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ ও শক সিনড্রোমের মতো জটিলতা দেখা দিচ্ছে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূল কাজটি স্থানীয় সরকার ও জনসাধারণের যৌথভাবে করতে হবে। শুধু হাসপাতাল প্রস্তুত রাখলে হবে না; এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”

স্থানীয় প্রশাসনের পদক্ষেপ

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট এলাকায় লার্ভা ধ্বংস অভিযান চালানো হচ্ছে। বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন ও জলাশয়ে এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে নাগরিকদের অভিযোগ, অভিযান নিয়মিত হলেও কার্যকারিতা সীমিত। অনেকে বলছেন, “মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, কিন্তু তা টেকসই নয়। কয়েকদিন পরই মশা আবার বাড়ছে।”

সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা জানান, জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

পূর্বের তুলনায় পরিস্থিতি কেমন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও মৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০২৪ সালে এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৫৫, আর এবার তা বেড়ে ২৮৩-তে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক রোগী শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসছেন বলে মৃত্যুর হার বেড়েছে। পাশাপাশি, সেকেন্ডারি ইনফেকশন বা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।

সচেতনতার অভাবে বিপর্যয় বাড়ছে

জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, নাগরিকদের সচেতনতার অভাবও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা। অনেকেই বাড়ির ছাদে, ফুলের টবে বা টিনের ছাদে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখেন না। এই পানিতেই এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, সামান্য জ্বর, চোখ ব্যথা বা শরীরে ব্যথা দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করানো জরুরি। সময়মতো শনাক্ত না হলে রোগটি জটিল আকার ধারণ করে।

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও করণীয়

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে পারে। কারণ, এখনো দেশের অনেক স্থানে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে এবং তাপমাত্রা অনুকূলে থাকায় মশা বংশবিস্তার করছে।
জনস্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড ও ওষুধ মজুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সবাইকে পরামর্শ দিয়েছে, পানি জমে থাকতে না দেওয়া, ঘরের চারপাশ পরিষ্কার রাখা এবং সকাল-বিকেলে মশা প্রতিরোধক স্প্রে ব্যবহার করার।

ডেঙ্গু এখন আর শুধু নগরকেন্দ্রিক সমস্যা নয়; এটি সারাদেশের জন্য এক স্বাস্থ্য-সঙ্কট। প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সময়মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতাই হতে পারে এই বিপর্যয় রোধের একমাত্র উপায়।

এম আর এম – ২০৪৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button