এক শিশুর অসাধারণ সাফল্য: ৯ মাসেই পূর্ণ কোরআন হিফজ
চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার বিনন্দপুর মদীনাতুল উলুম নূরানী ও হাফেজিয়া কওমি মাদ্রাসায় মাত্র ৯ মাসে সম্পূর্ণ পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ১১ বছর বয়সী এক শিশু শিক্ষার্থী — ইয়াছিন আরাফাত।
লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের সন্তান ইয়াছিন, পিতা মো. সবুজের স্বপ্ন ছিল তাঁর ছেলে যেন আল্লাহর কালামকে অন্তরে ধারণ করে। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
অনুষ্ঠান ও সম্মাননা: পাগড়ি পরিয়ে হাফেজের মর্যাদা প্রদান
শনিবার সকালে মাদ্রাসার মিলনায়তনে এক অনাড়ম্বর কিন্তু হৃদয়স্পর্শী আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ইয়াছিনের “দস্তারবন্দী” অনুষ্ঠান — যা হাফেজে কোরআনদের সম্মাননা প্রদানের এক ঐতিহ্যবাহী প্রথা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত আলেম মুফতি গোলাম সরোয়ার ফরিদী, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়াছিনের মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেন। এই প্রতীকী মুহূর্তে উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন:
- মাওলানা মুনসুর আহমেদ
- মুফতি হাবিবুর রহমান মাহমুদী
- মাওলানা জাহিদুল ইসলাম
- মাদ্রাসার উপদেষ্টা আ. ছাত্তার মাস্টার
- সমাজসেবক নূরে আলম সিদ্দিকী সেলিম
- জসিম উদ্দিন প্রমুখ
মাদ্রাসার পক্ষ থেকে গর্বের অভিব্যক্তি
মাদ্রাসার মোহতামিম (অধ্যক্ষ) মুফতি আব্দুল্লাহ আল জামি বলেন,
“ইয়াছিন আরাফাত মাত্র ৯ মাস আগে আমাদের মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে ভর্তি হয়। শিক্ষক মাহাদী হাসান তামিমের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে ও কঠোর পরিশ্রমে সে পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করেছে। আল্লাহর রহমতে সে এখন একজন পূর্ণাঙ্গ হাফেজে কোরআন।”
তিনি আরও বলেন,
“একজন শিশুর এমন সাফল্য আমাদের মাদ্রাসা ও সমাজের জন্য গৌরবের। ইয়াছিনের অধ্যবসায় অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।”
শিক্ষকের চোখে ইয়াছিন: পরিশ্রম, ধৈর্য ও নিষ্ঠার এক মডেল
ইয়াছিনের হেফজ শিক্ষক হাফেজ মাহাদী হাসান তামিম জানান,
“ইয়াছিন খুব শান্ত, ভদ্র ও মনোযোগী ছাত্র। প্রথম দিন থেকেই তার মধ্যে এক বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করেছিলাম। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের বেশি পরিশ্রম করেছে সে। কখনো ক্লান্ত হয়নি, কখনো হাল ছাড়েনি।”
তামিম আরও বলেন,
“আমরা প্রতিদিন সকালে ক্লাস শুরু করতাম কোরআন তিলাওয়াত দিয়ে। ইয়াছিন একনাগাড়ে শুনে, বুঝে, শুদ্ধ উচ্চারণে আয়াত মুখস্থ করত। ৯ মাসে সম্পূর্ণ কোরআন শেষ করা সত্যিই এক অসাধারণ অর্জন।”
ইয়াছিনের পরিবার: ত্যাগ ও প্রেরণার গল্প
ইয়াছিনের বাবা মো. সবুজ একজন সাধারণ কৃষক। তিনি বলেন,
“আমার সামর্থ্য বেশি নয়, কিন্তু ছেলেকে কোরআন শেখানোর ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকেই। প্রতিদিন নামাজ শেষে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, যেন আমার ছেলে কোরআনের হাফেজ হয়। আজ আমার সেই দোয়া কবুল হয়েছে।”
মা রুবিনা বেগম বলেন,
“ইয়াছিনকে ছোটবেলা থেকেই নামাজ, দোয়া শেখাতাম। সে খুব ভক্তি নিয়ে আল্লাহর কথা শুনত। এখন সে পুরো কোরআন মুখস্থ করেছে — এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
স্থানীয় সমাজের প্রতিক্রিয়া: গর্ব ও অনুপ্রেরণার উৎস
বিনন্দপুর মাদ্রাসা ও আশেপাশের এলাকার মানুষ ইয়াছিনের এই অর্জনে গভীর গর্ব অনুভব করছেন। প্রতিবেশীরা জানান,
“এমন প্রতিভাবান শিশু আমাদের এলাকায় বিরল। ইয়াছিন আমাদের সমাজের গর্ব।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও প্রশংসা করেছেন তার কীর্তি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন,
“যে বয়সে শিশুরা এখনো খেলাধুলা ও মোবাইল গেমে মগ্ন, সে বয়সে ইয়াছিন আল্লাহর বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করেছে। আমরা তার জন্য গর্বিত।”
বাংলাদেশে হাফেজ তৈরির ঐতিহ্য ও সমাজে এর প্রভাব
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার শিক্ষার্থী পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে হাফেজে কোরআন হওয়ার মর্যাদা অর্জন করে। এরা দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানে ইমাম, শিক্ষক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অল্প বয়সে হিফজ শুরু করলে শিশুদের মেমোরি, মনোযোগ এবং নৈতিক শিক্ষা অনেক উন্নত হয়। ইয়াছিনের মতো প্রতিভাবান শিশুরা তাই ইসলামী শিক্ষার জগতে এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
ইয়াছিনের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ হাফেজ হওয়ার পর এখন ইয়াছিনের লক্ষ্য কওমি মাদ্রাসার দারুল হাদিস বিভাগে ভর্তি হয়ে ইসলামি জ্ঞান আরও গভীরভাবে অর্জন করা।
ইয়াছিন বলেন,
“আমি বড় হয়ে একজন আলেম হতে চাই। আল্লাহর বাণী মানুষকে শোনাতে চাই। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।”
ধর্মীয় ও শিক্ষাবিদদের প্রতিক্রিয়া
চাঁদপুর জেলা কওমি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুফতি আবদুর রহমান বলেন,
“এমন অর্জন শিশুদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা। হিফজ শুধু মুখস্থ নয়, এটি চরিত্র গঠন ও নৈতিকতার শিক্ষাও দেয়। ইয়াছিনদের মতো শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ।”
ইসলামী গবেষক মাওলানা শহিদুল ইসলাম মন্তব্য করেন,
“এটি প্রমাণ করে, সঠিক তত্ত্বাবধান ও নিষ্ঠা থাকলে বয়স কোনো বাধা নয়। মাত্র ৯ মাসে পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করা অলৌকিক নয়, এটি অধ্যবসায় ও ঈমানের ফল।”
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা: নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ
বিনন্দপুর মদীনাতুল উলুম নূরানী ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এখন ইয়াছিনের মতো আরও প্রতিভাবান শিক্ষার্থী তৈরিতে বিশেষ হিফজ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। এতে থাকবে:
- শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত তত্ত্বাবধান
- মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের অনুশীলন ও মূল্যায়ন
- পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি
একজন ১১ বছরের শিশুর এমন অসাধারণ কীর্তি শুধু মাদ্রাসা নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য গর্বের। ইয়াছিন আরাফাতের ৯ মাসে হাফেজ হওয়া দেখিয়ে দিল, মনোযোগ, পরিশ্রম ও আল্লাহর রহমত থাকলে অসম্ভব কিছুই নেই।
সমাজ, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাই যদি এমন প্রতিভা লালন করে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরও অসংখ্য ইয়াছিন জন্ম নেবে, যারা ধর্ম ও নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে দেবে সারা দেশে।
MAH – 13586 I Signalbd.com



