বাংলাদেশ

মডেল মসজিদে দুর্নীতি ও অনিয়ম: সরকারের মহাপরিকল্পনা প্রশ্নের মুখে

Advertisement

বাংলাদেশ সরকারের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ছিল— “প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ।”
ধর্মীয় মূল্যবোধ, শিক্ষা, গবেষণা এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে নেওয়া এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে— দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে বহুমাত্রিক অনিয়ম, নিম্নমানের নির্মাণকাজ ও দুর্নীতির অভিযোগ।

১৫ কোটি টাকার মসজিদ, কিন্তু কাজের মানে অসন্তোষ

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যা বাজার এলাকায় প্রায় ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে একটি “মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।”
প্রকল্পটির কাজের দায়িত্বে রয়েছে কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগ, আর ঠিকাদারি কাজটি পেয়েছে মেসার্স এস আর এন ইয়াকুব এন্টারপ্রাইজ।

তবে মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, মসজিদটির কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি।
নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ শেষ করার অজুহাতে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুসল্লিরা।

‘আমগাছের তক্তা’ দিয়ে ঢালাই – অবিশ্বাস্য অনিয়ম

২০২৪ সালের জুন মাসে মসজিদের নিচতলার ঢালাইয়ের সময় বড়সড় একটি ঘটনা ঘটে।
নির্মাণকাজে লোহার পাতের পরিবর্তে আমগাছের তক্তা ব্যবহার করা হয়। ফলে নিচ তলার অন্তত আটটি গ্রেড বিম ধসে পড়ে।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মুসল্লিরা।

কিছুদিন পর আবার নতুনভাবে কাজ শুরু হয়, কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ—
“দোষীদের শাস্তি হয়নি, কাজের মানও আগের মতোই নিম্নমানের।”

মার্বেল বদলে টাইলস, অসম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা

প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় মার্বেল পাথর বসানোর কথা থাকলেও বাস্তবে কেবল দ্বিতীয় তলাতেই তা বসানো হয়েছে।
বাকি দুটি তলায় বসানো হচ্ছে সাধারণ টাইলস।
এছাড়া এখনো হয়নি—

  • বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার স্থাপন
  • জেনারেটর সংযোগ
  • প্রধান গেট নির্মাণ
  • পুকুর সংস্কার
  • অতিরিক্ত অজুখানা

এমনকি, বিদ্যমান কিছু দেয়ালেও গাঁথুনির ফাটল ও ঢালাই ত্রুটি চোখে পড়ছে।

স্থানীয়দের ক্ষোভ: “এটি আমাদের গর্ব, কিন্তু এমন অনিয়মে লজ্জিত”

স্থানীয় মুসল্লি ইউসুফ আলী বলেন,

“এটি আমাদের এলাকার গর্বের মসজিদ। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করেছে, সেভাবে কাজ হলে আমরা গর্ববোধ করতাম। কিন্তু নিম্নমানের নির্মাণ দেখে মন খারাপ হয়ে যায়।”

আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ জহির বলেন,

“মসজিদের নাম ‘মডেল মসজিদ’, অথচ কাজের মান দেখলে তা আদৌ কোনো মডেলের সঙ্গে যায় না। আমরা তদন্ত চাই, যাতে সরকারি টাকা অপচয় না হয়।”

ইউপি সদস্যের মন্তব্য: ‘তড়িঘড়ি করে শেষ করার চেষ্টা চলছে’

হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মনজুর আলম বলেন,

“কাজের মান অত্যন্ত খারাপ। ঢালাই ও গাঁথুনির মান নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছু অংশে বলা অনুযায়ী ঠিক করা হয়, কিন্তু কিছুদিন পরই পুরোনো অবস্থায় ফিরে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে— অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”

তিনি আরও বলেন,

“কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার আগে ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, গেট, পুকুর সংস্কার ও মার্বেল বসানোর কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”

ঠিকাদারের সাফাই: ‘বাজেট অনুযায়ী কাজ করছি’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন দেলোয়ার হোসেন মিন্টু।
মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান,

“বাজেট অনুযায়ী যতটা সম্ভব মান বজায় রেখে কাজ করছি। বাজেটের বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত অংশ যেমন অজুখানা বা পুকুর সংস্কার— এগুলো পরে দেখা হবে।”

এরপর তিনি সংযোগ কেটে দেন।

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া: তদন্ত চলছে

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন,

“এই মসজিদের কাজের দায়িত্বে আছে কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগ। স্থানীয় অভিযোগ আমরা পেয়েছি, তা যাচাই করা হচ্ছে। লিখিত অভিযোগ দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন,

“জেনারেটর না দেওয়ার কারণ বাজেট সীমাবদ্ধতা। পুকুর সংস্কারের বাজেট নেই। তবে ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করা হবে। বাজেট অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় টাইলসই দেওয়া হচ্ছে।”

মডেল মসজিদ প্রকল্প: লক্ষ্য ও বাস্তবতা

২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
উদ্দেশ্য ছিল— ইসলামিক শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দাওয়াতের আধুনিক কেন্দ্র গড়ে তোলা।

প্রকল্পের অধীনে মোট ৫৬৪টি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার মধ্যে:

  • ৫০টি জেলা শহরে,
  • ৪১৪টি উপজেলা পর্যায়ে,
  • ১০০টি শহর এলাকায় নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

প্রতি মসজিদের ব্যয় ধরা হয় ১৩ থেকে ১৫ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকারও বেশি।

দেশজুড়ে একই অভিযোগ: নিম্নমান, দেরি ও স্বচ্ছতার ঘাটতি

উখিয়ার ঘটনাটি একক নয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকায়—

  • চাঁদপুর,
  • নওগাঁ,
  • যশোর,
  • বগুড়া,
  • পটুয়াখালী,
  • সিলেট—
    এসব জায়গাতেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে।

চাঁদপুরে এক মুসল্লি জানান,

“মসজিদের ছাদ ফাটল ধরেছে উদ্বোধনের এক মাসের মধ্যে।”

নওগাঁয় স্থানীয় গণপূর্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন,

“ঠিকাদারদের দ্রুত কাজ শেষ করার চাপ থাকায় মান নিয়ন্ত্রণ কঠিন।”

এই অভিযোগগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো বড় তদন্ত বা জবাবদিহি দেখা যায়নি।

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

“প্রকল্পটি একটি জাতীয় মহাপরিকল্পনা। এত বড় সংখ্যক ভবন নির্মাণে কিছু জায়গায় ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করছি, অনিয়ম পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

তবে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন—

“কাগজে যতটা কঠোর ব্যবস্থা দেখানো হয়, বাস্তবে তা ততটা কার্যকর নয়।”

বিশেষজ্ঞ মতামত: ‘ধর্মীয় প্রকল্পে স্বচ্ছতা সবচেয়ে জরুরি’

নির্মাণ প্রকৌশলী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম বলেন,

“ধর্মীয় স্থাপনা মানে শুধু ভবন নয়, এটি মানুষের বিশ্বাসের প্রতীক। সেখানে নিম্নমানের কাজ করা মানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। এই প্রকল্পে টেকনিক্যাল অডিট বাধ্যতামূলক করা উচিত।”

জনগণের প্রত্যাশা ও সরকারের করণীয়

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চায়—
এই প্রকল্পটি যেন সত্যিকারের আদর্শ হয়, দুর্নীতির নয়।
যে মসজিদে মানুষ নামাজ পড়বে, ইসলামিক শিক্ষা নেবে, শিশু ও নারীরা ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করবে— সেই স্থাপনায় যেন কোনো অনিয়ম না থাকে।

সরকার যদি সময়মতো গভীর তদন্ত, মান যাচাই, ও জবাবদিহি ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, তবে এই প্রকল্প আবারও জনআস্থার প্রতীক হতে পারে।
অন্যথায়, “মডেল মসজিদ” প্রকল্পটি হয়ে উঠবে আরেকটি ব্যর্থ উন্নয়ন উদ্যোগের উদাহরণ।

উখিয়ার মডেল মসজিদ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ কেবল একটি উদাহরণ।
এটি দেখিয়ে দিয়েছে, বড় কোনো প্রকল্পে যদি জবাবদিহি, তদারকি ও সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ না থাকে— তাহলে কোটি কোটি টাকার উন্নয়নও জনগণের বিশ্বাস হারায়।

বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ দেশে একটি মসজিদ কেবল ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়— এটি বিশ্বাস, ঐক্য ও নৈতিকতার প্রতীক।
সেই প্রতীক যেন কোনোভাবেই দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজের ছোঁয়ায় কলঙ্কিত না হয়— এটিই এখন সময়ের দাবি।

MAH – 13556 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button