বাংলাদেশ

ঈদ বোনাস দ্বিগুণের প্রস্তাব সরকারি চাকরিজীবীদের

Advertisement

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সুখবর আসতে পারে নবম পে স্কেলের প্রস্তাবনায়। বাংলাদেশ ফরেস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) জাতীয় পে কমিশনের কাছে এমন একটি প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ঈদ বোনাস দ্বিগুণ করা, বেতনভাতা বৃদ্ধি, ঝুঁকি ভাতা ও চিকিৎসা সুবিধা উন্নয়নসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বুধবার (২৯ অক্টোবর ২০২৫) রাজধানীতে জাতীয় পে কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সংগঠনটি এই প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করে। বিএফএ বলছে, দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা রাষ্ট্রের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তাদের জীবনযাত্রার মান মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না। তাই নতুন পে স্কেলে তারা বাস্তবসম্মত বেতন কাঠামো এবং যথাযথ আর্থিক সুবিধার দাবি জানাচ্ছে।

বেতন কাঠামো ও ভাতায় বড় পরিবর্তনের দাবি

প্রস্তাব অনুযায়ী, সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো অনুসারে সর্বনিম্ন বেতন ৮,২৫০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৭৮,০০০ টাকা। প্রায় এক দশক পর প্রস্তাবিত এই নতুন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া, সব গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৬০ শতাংশ করার দাবি জানানো হয়েছে। বর্তমানে এটি ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিএফএ বলেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাসাভাড়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে সরকারি কর্মকর্তারা আর্থিকভাবে চাপে পড়েছেন। তাই ন্যায্য আবাসন সুবিধার জন্য এই হার বৃদ্ধি সময়ের দাবি।

ঈদ বোনাস দ্বিগুণ করার প্রস্তাব

সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো— ঈদ বোনাস দ্বিগুণ করার দাবি। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা বছরে দুটি ঈদে মূল বেতনের সমপরিমাণ বোনাস পান। বিএফএর প্রস্তাব, ঈদ বোনাসকে দ্বিগুণ করা হোক, যাতে দীর্ঘ কর্মপরিসরে সরকারি কর্মচারীদের উৎসাহ, মনোবল ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে।

সংগঠনটির মতে, “সরকারি চাকরিজীবীরা সারা বছর দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্রের স্বার্থে। তাদের জন্য ঈদ উৎসবের সময় সামান্য অতিরিক্ত আনন্দের সুযোগ থাকা উচিত।”

শিক্ষা, চিকিৎসা ও টিফিন ভাতা বৃদ্ধির দাবি

বিএফএর লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের সন্তানদের শিক্ষাব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই এক সন্তানের জন্য শিক্ষা ভাতা ২ হাজার টাকা এবং দুই সন্তানের জন্য ৪ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এছাড়া চিকিৎসা ভাতা প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা এবং টিফিন ভাতা ৩ হাজার টাকা করার প্রস্তাবও জানানো হয়েছে। সংগঠনটির বক্তব্য, “একজন সরকারি কর্মচারী যদি নিজস্ব অর্থে চিকিৎসা বা সন্তানদের শিক্ষাব্যয় চালাতে না পারেন, তাহলে তার কর্মদক্ষতা ও মানসিক স্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্টের নতুন প্রস্তাব

বিএফএ প্রস্তাব করেছে, প্রতি বছর বৈশাখী ভাতা মূল বেতনের সমান দেওয়া হোক। পাশাপাশি, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা উচিত বলে মত দিয়েছে সংগঠনটি। তাদের যুক্তি, বর্তমান বাজারদর ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পেনশন ও অবসরের সুবিধা উন্নয়ন

সরকারি চাকরিজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি— অবসরের পরও যেন তারা আর্থিক নিরাপত্তা পান। বিএফএ এই বিষয়েও স্পষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের দাবি, পেনশন সুবিধা ১০০ শতাংশ করা হোক এবং পেনশন প্রক্রিয়া আরও সহজ ও ডিজিটালাইজড করা হোক, যাতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার না হন।

ঝুঁকি ভাতা ও নিরাপত্তা সুবিধা

বিশেষ করে বন বিভাগে কর্মরত ফরেস্টাররা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বন রক্ষা ও বনজ অপরাধ প্রতিরোধে তারা প্রায়ই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।

তাই বিএফএর দাবি, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সব কর্মচারীর ঝুঁকি ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ করতে হবে। একইসঙ্গে দায়িত্ব পালনকালে আহত বা নিহত হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রস্তাবও তারা দিয়েছে।

ডিপ্লোমাধারী ফরেস্টারদের বেতন ও মর্যাদার বিষয়

বিএফএর লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপ্লোমা-ইন-ফরেস্ট্রি শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন সব ফরেস্টারদের বেতন গ্রেড অন্যান্য ডিপ্লোমাধারীদের মতো ১০ম গ্রেডদ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দিতে হবে।

হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা (রিট নং ৭০০১/২০১৭ ও সিভিল পিটিশন নং ২৭৩৬/২০২১) অনুযায়ী দ্রুত তাদের বেতন ও পদমর্যাদা বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

নিয়মিত পে কমিশনের দাব

বিএফএ বলেছে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর পে কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে দেশের মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় ও আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা আপডেট করা যায়। দীর্ঘ বিরতি না দিয়ে নিয়মিতভাবে পে কমিশন করলে কর্মচারীদের অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটাই কমে আসবে বলে তাদের মতামত।

সরকারি বেতন কাঠামো নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে সর্বশেষ জাতীয় বেতন কাঠামো কার্যকর হয় ২০১৫ সালে। সেই কাঠামোর পর থেকে মূল্যস্ফীতি, ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষাখাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তবু এখনো নতুন পে স্কেল ঘোষিত হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ ১০ বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের আয় সেই হারে বাড়েনি। ফলে নতুন বেতন কাঠামোর দাবিটি এখন অত্যন্ত যৌক্তিক হয়ে উঠেছে।

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী ধাপ

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “জাতীয় পে কমিশন বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন ও বিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করছে। সব দিক পর্যালোচনা করে কমিশন একটি সমন্বিত খসড়া প্রস্তাব সরকারে জমা দেবে। এরপর মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদনের পর কার্যকর হবে।”

তিনি আরও বলেন, “ঈদ বোনাস ও ভাতা সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কারণ কর্মচারীদের মনোবল বাড়ানো রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য জরুরি।”

জনমত ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি বেতন কাঠামো শুধু কর্মচারীদের সুবিধার বিষয় নয়, এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। একদিকে কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে বাজারে চাহিদা বাড়ে, অন্যদিকে সরকারের ব্যয়ও বাড়ে। তাই ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, “পে কমিশনের প্রস্তাব যদি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন আসবে। তবে বাজেটের চাপও বিবেচনা করতে হবে।”

বাংলাদেশ ফরেস্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই প্রস্তাব শুধু বন বিভাগের নয়, বরং দেশের সব সরকারি চাকরিজীবীদের দাবি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে কর্মজীবী শ্রেণি যেভাবে অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে, নতুন পে স্কেল বাস্তবায়িত হলে তা অনেকটা লাঘব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এখন সবার দৃষ্টি সরকারের দিকে— তারা কত দ্রুত এবং কতটা উদারভাবে এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে তা-ই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ সরকারি চাকরিজীবীদের আর্থিক ভাগ্য।

MAH – 13543 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button