বাংলাদেশ

ঢাকায় আসছেন ড. জাকির নায়েক: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে ‘অবগত নয়’

Advertisement

ধর্মীয় চিন্তাবিদ ড. জাকির নায়েকের সফর নিয়ে আলোচনা শুরু, প্রশ্ন উঠছে অনুমতি ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে

ইসলামী বক্তা ও ধর্মীয় চিন্তাবিদ ড. জাকির নায়েককে ঘিরে আবারও আলোচনায় বাংলাদেশ। শোনা যাচ্ছে, তিনি আগামী ২৮ নভেম্বর ঢাকায় আসছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও কিছু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে একটি বড় ইসলামী সম্মেলনে অংশ নিতে তিনি এই সফর করবেন।

তবে এই সফর সম্পর্কে এখন পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানে না বলে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা ড. জাকির নায়েকের সফর সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। সাংবাদিকদের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছি।”

এই বক্তব্যের পর থেকেই বিষয়টি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কোনো বিদেশি নাগরিক যদি সরকারি অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে আসেন, সেটি কীভাবে সম্ভব হবে? আবার কেউ কেউ বলছেন, এটি এখনো কেবল প্রাথমিক পর্যায়ের পরিকল্পনা হতে পারে।

কে এই ড. জাকির নায়েক?

ড. জাকির নায়েক একজন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বক্তা ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিশ্লেষক। তিনি ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (IRF) নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজি ও আরবি ভাষায় তার যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

তার টেলিভিশন চ্যানেল পিস টিভি (Peace TV) দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সম্প্রচারিত হতো। তবে তার কিছু বক্তব্য ও কার্যক্রমকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়, বিশেষ করে ২০১৬ সালে ভারতের মুম্বাই হামলার পর। ভারত সরকার তার সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করে।

এরপর থেকে তিনি মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাস করছেন। মালয়েশিয়া সরকার তাকে “ধর্মীয় উপদেষ্টা” হিসেবে সীমিত কার্যক্রমের অনুমতি দিয়েছে।

বাংলাদেশে আসা নিয়ে কেন এত আলোচনা?

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে ধর্মীয় বক্তা ও চিন্তাবিদদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বরাবরই বেশি। তবে ড. জাকির নায়েকের মতো বিতর্কিত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সফর অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত।

সরকারি অনুমতি ছাড়াই তার আগমনের ঘোষণা আসায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, “এটি কি কূটনৈতিক প্রটোকল লঙ্ঘন নয়?”

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একজন বিদেশি নাগরিক—বিশেষ করে বিতর্কিত অবস্থানধারী—দেশে প্রবেশের আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘অবগত নয়’ বললেও, বিষয়টি ভবিষ্যতে জটিল হতে পারে।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের দাবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্টে দেখা যায়, একটি বেসরকারি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা আগামী ২৮ নভেম্বর ঢাকায় “ইসলামিক কনফারেন্স বাংলাদেশ ২০২৫” আয়োজন করবে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ড. জাকির নায়েক।

তবে ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ না করলেও সূত্র বলছে, আয়োজকরা ইতিমধ্যে কয়েকটি হোটেল ও কনভেনশন সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো বিদেশি বক্তা বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানাতে হলে প্রথমে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়।

সরকারি প্রতিক্রিয়া: এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেই

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, “ড. নায়েকের সফর নিয়ে কোনো চিঠি বা নোটিশ আমরা পাইনি। এটা সম্ভবত একটি বেসরকারি উদ্যোগ, তবে এমন বিষয়ে সরকারের অনুমোদন জরুরি।”

তিনি আরও বলেন, “বিদেশি নাগরিকরা চাইলে বাংলাদেশে আসতে পারেন, কিন্তু যদি তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক অভিযোগ থাকে, তবে বিষয়টি সতর্কভাবে বিবেচনা করা হয়।”

নির্বাচন ও বিদেশি পর্যবেক্ষক প্রসঙ্গেও বক্তব্য

ড. জাকির নায়েকের প্রসঙ্গ ছাড়াও তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে।

তিনি বলেন, “আমরা এমন কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক চাই না যারা অহেতুক বিতর্ক তৈরি করবে বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কেউই বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় কোনো অনিশ্চয়তা দেখছে না। সবাই বিশ্বাস করে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে।”

চীন-যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান

একই আলোচনায় তিনি বলেন, “চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। আমরা কারও শত্রু নই, কারও প্রভাবাধীনও নই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি খুবই স্পষ্ট—‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’।’’

বিশ্লেষকদের মতে, ড. নায়েকের সফর যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন আলোচনার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে ভারত ও মালয়েশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

ভারত সরকার বহু বছর ধরেই ড. জাকির নায়েককে প্রত্যর্পণ চেয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশ সফরের খবর প্রকাশের পর ভারতের গণমাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতীয় একাধিক পত্রিকা জানিয়েছে, “ঢাকায় নায়েকের সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।”

ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেয়, তবে সেটি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: জনপ্রিয়তা বনাম বিতর্ক

বাংলাদেশের অনেক তরুণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ড. নায়েকের বক্তৃতা পছন্দ করেন। ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বক্তৃতার ভিডিও লাখ লাখ মানুষ দেখেন।

তবে ধর্মীয় বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, “তার বক্তৃতায় কখনো কখনো অতিরিক্ত ধর্মীয় উগ্রতা বা একপাক্ষিক ব্যাখ্যা থাকে, যা সমাজে বিভাজন তৈরি করতে পারে।”

ইসলামী গবেষক মাওলানা সাঈদুল হক বলেন, “আমরা যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে ধর্ম বুঝতে চাই, কিন্তু কেউ যদি অন্য ধর্ম বা মতবাদকে অসম্মান করে, সেটি ইসলাম সমর্থন করে না।”

বাংলাদেশ সরকারের চ্যালেঞ্জ

যদি সত্যিই ড. জাকির নায়েক বাংলাদেশ সফরে আসেন, তবে সরকারকে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত সতর্কভাবে মোকাবিলা করতে হবে—
১. তার প্রবেশের অনুমতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা,
২. সফরকে ঘিরে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উত্তেজনা যেন না তৈরি হয়,
৩. বিদেশি কূটনৈতিক সম্পর্ক—বিশেষ করে ভারতের প্রতিক্রিয়া—বিবেচনায় নেওয়া।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে নির্বাচনের প্রাক্কালে রয়েছে। এমন সংবেদনশীল সময়ে এই সফর রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে পারে, যা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।”

মানুষ কী ভাবছে?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বলছেন, “নায়েকের মতো জ্ঞানী ইসলামী বক্তাকে দেশে আসতে দেওয়া উচিত।” আবার কেউ বলছেন, “যিনি বিতর্কিত, তার আগমন সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।”

একজন মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশে তিনি আসুক, তবে যেন সব প্রক্রিয়া মেনে আসে।”

অন্যদিকে, অনেকেই মনে করছেন, “বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।”

সফর হবে কি না—সিদ্ধান্ত এখন সরকারের হাতে

সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনিশ্চিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘অবগত নয়’ বললেও, যদি আয়োজক সংস্থা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্য আবেদন করে, তবে সেটি সরকারের বিবেচনার বিষয় হবে।

যে কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামাজিক শান্তির ভারসাম্য রক্ষার ওপর নির্ভর করবে।

ড. জাকির নায়েকের বাংলাদেশ সফরের গুঞ্জন শুধু একটি ধর্মীয় ইভেন্টের খবর নয়, বরং এটি একটি কূটনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এখন দৃষ্টি সবার—সরকারি অনুমতি মিলবে কি না, ভারত ও অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া কী হবে, এবং বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে এই ঘটনাকে গ্রহণ করবে, তার দিকেই।

যেভাবেই হোক, আগামী কয়েক সপ্তাহ এই বিষয়টি দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

MAH – 13518 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button