বিয়ারিং প্যাড (Bearing Pad) হলো এক ধরনের রাবার বা ইলাস্টোমার-নির্মিত যন্ত্রাংশ, যা সেতুর গার্ডার ও পিয়ারের (Bridge Girder এবং Pier) মাঝখানে স্থাপন করা হয়। এটি সেতুর উপরের অংশ থেকে নিচের অংশে ভার ও কম্পন সুষমভাবে বিতরণ করে। অর্থাৎ, সেতুর ওপর দিয়ে যখন যানবাহন চলে, তখন সৃষ্ট চাপ, কম্পন ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব এই প্যাডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
প্রকৌশলীদের ভাষায়, বিয়ারিং প্যাড সেতুর “সাপোর্ট সিস্টেম”-এর প্রাণ। এটি সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে এবং ফাটল বা ধসের ঝুঁকি কমায়।
কেন বিয়ারিং প্যাড বসানো হয়
সেতুর কাঠামোয় বিয়ারিং প্যাডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তিনটি কারণে এই প্যাড বসানো হয়—
১. ভার সুষম বণ্টন: সেতুর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচলের সময় সৃষ্ট চাপ পিয়ারের ওপর সমানভাবে বণ্টন করতে সাহায্য করে।
২. তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ: তাপমাত্রা বাড়া-কমার কারণে সেতুর ধাতব অংশ প্রসারিত বা সংকুচিত হয়; বিয়ারিং প্যাড এই পরিবর্তনের ধাক্কা সামাল দেয়।
৩. কম্পন ও আঘাত শোষণ: চলাচলের সময় সৃষ্ট কম্পন বা আঘাত শোষণ করে, যাতে গার্ডার বা কংক্রিটে ক্ষতি না হয়।
ফলে সেতুর ভারসাম্য ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে বিয়ারিং প্যাড অপরিহার্য।
কীভাবে খুলে পড়তে পারে বিয়ারিং প্যাড
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার মূলত তিনটি কারণ থাকতে পারে।
১. ত্রুটিপূর্ণ স্থাপন: সেতু নির্মাণের সময় যদি প্যাডের অবস্থান বা লেভেল সঠিক না হয়, তবে সময়ের সাথে এটি সরে যেতে পারে।
২. রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি: বিয়ারিং প্যাড নির্দিষ্ট সময় পরপর পরীক্ষা করতে হয়। রাবার অংশে ফাটল বা বিকৃতি দেখা দিলে সেটি দ্রুত পরিবর্তন না করলে এটি খুলে পড়তে পারে।
৩. অতিরিক্ত কম্পন বা ভার: ভারী যানবাহন, অতিরিক্ত কম্পন, বা দীর্ঘ সময় ধরে লোড চাপের কারণে প্যাডের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এটি আলগা হয়ে পড়ে যেতে পারে।
প্রকৌশলীদের মন্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সেতু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার হুমায়ুন কবির বলেন,
“বিয়ারিং প্যাড হলো সেতুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে সেতুর ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। একটি প্যাড খুলে পড়লে পুরো কাঠামোয় চাপের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা বিপজ্জনক।”
তিনি আরও বলেন, দেশে অধিকাংশ সেতুতে রাবার বিয়ারিং ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ১০-১৫ বছর পর পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। নিয়মিত পরিদর্শন না থাকলে প্যাড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর সেই ক্ষতি চোখে পড়ার আগেই বড় সমস্যা তৈরি করে।
রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব
বিয়ারিং প্যাডের স্থায়িত্ব নির্ভর করে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ওপর। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) একজন প্রকৌশলী জানান, প্রতিটি সেতুর বিয়ারিং প্যাড বছরে অন্তত একবার পরিদর্শন করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক সেতুতেই এ রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না।
রক্ষণাবেক্ষণের সময় সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয়—
- প্যাডের নিচে ও উপরের পৃষ্ঠে ফাটল আছে কি না
- রাবার স্তর চ্যাপ্টা হয়ে গেছে কি না
- প্যাডের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে কি না
- গার্ডার ও পিয়ারের সংযোগ স্থিতিশীল আছে কি না
এগুলোর যেকোনো একটি ত্রুটি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত বা পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
দেশের সেতুগুলোর বর্তমান অবস্থা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা দেশে হাজার হাজার সেতু নির্মিত হয়েছে। তবে সব সেতুর বিয়ারিং প্যাড রক্ষণাবেক্ষণ সমানভাবে হয় না। স্থানীয় প্রকৌশল অফিসগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেটের অভাবে অনেক স্থাপনাই অবহেলিত থাকে।
দুদক ও সেতু বিভাগের যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫ বছরে দেশের অন্তত ১৪টি সেতুর বিয়ারিং প্যাড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা খুলে পড়েছে। তবে সময়মতো মেরামত করায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে নির্মাণ ত্রুটি, মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি এবং নিয়মিত তদারকির অভাব।
ভবিষ্যতে কী করা দরকার
প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রতিটি সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ লগবুক থাকা উচিত, যেখানে বিয়ারিং প্যাডসহ প্রতিটি উপাদানের অবস্থা নথিভুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও প্রকৌশল বিভাগকে নিয়মিত যৌথ পরিদর্শন চালাতে হবে।
যদি সঠিক পরিকল্পনা ও বাজেট ব্যবস্থাপনা থাকে, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। কারণ বিয়ারিং প্যাড একটি ছোট উপাদান হলেও এটি পুরো সেতুর স্থায়িত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনাকে হালকাভাবে দেখলে চলবে না। এটি সেতুর নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত একটি বিষয়। নিয়মিত পরীক্ষা, মানসম্মত স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে দেশের সেতুগুলোর দীর্ঘস্থায়িত্ব আরও বাড়ানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি নজরদারি বাড়ানো না হয়, ভবিষ্যতে বড় দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন হবে।
এম আর এম – ১৯৪৮,Signalbd.com



