নবম জাতীয় বেতন কমিশনের সামনে নতুন প্রস্তাব — সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার, সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কর্মচারী সংগঠনগুলোর দাবি, ন্যায্যতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় এ কাঠামো দ্রুত কার্যকর করতে হবে।
বেতন কাঠামোতে বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব
বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিডিপিএ) নবম জাতীয় বেতন কমিশনের কাছে নতুন বেতন কাঠামোর প্রস্তাব দিয়েছে। এতে সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা করার দাবি জানানো হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী বেতন কাঠামোকে ১২টি গ্রেডে পুনর্গঠন করা হবে, যাতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:৪ এর মধ্যে থাকে।
সংগঠনগুলোর দাবি, বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বাড়ানো সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। তারা বলছে, ছয় সদস্যের একটি পরিবারের ন্যূনতম জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করলেই বোঝা যায়—বর্তমান বেতন কাঠামো আর কার্যকর নয়।
২১ দফা দাবি উত্থাপন
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন ২১টি দাবি উত্থাপন করে। সংগঠনটির চেয়ারম্যান মো. সেলিম মিয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন, “২০১৫ সালের অষ্টম পে-স্কেল কার্যকরের পর থেকে কর্মচারীরা বৈষম্যমুক্ত বেতন কাঠামোর অপেক্ষায় আছে। নতুন পে-স্কেলে আমাদের দাবি হলো—বৈষম্যহীন, ন্যায্য ও বাস্তবসম্মত একটি কাঠামো।”
তিনি আরও বলেন, ১১ বছর পর এবার বেতন কাঠামো হালনাগাদ হতে যাচ্ছে। তাই এই কমিশনের উচিত জনগণের বাস্তব জীবনযাত্রার খরচ, বাজার মূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতির হার বিবেচনা করা।
সংগঠনটির ২১টি দাবির মধ্যে রয়েছে—বার্ষিক বেতন ১০ শতাংশ বৃদ্ধি, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল, রেশন পদ্ধতি চালু, শিক্ষা ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, এবং যাতায়াত ভাতা সমন্বয়।
বিডিপিএর পৃথক প্রস্তাব
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিডিপিএ)ও আলাদা একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে বেতন কমিশনের কাছে। সংগঠনটি বলেছে, দেশের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অথচ তাদের বেতন ও সুবিধা অনেক কম।
তারা প্রস্তাব করেছে, সর্বনিম্ন বেতন ৩৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণের পাশাপাশি বেতন কাঠামোকে ২০ গ্রেড থেকে কমিয়ে ১২ গ্রেডে আনা হোক। এতে একদিকে পদোন্নতির সুযোগ বাড়বে, অন্যদিকে বেতন বৈষম্য কমবে বলে তাদের দাবি।
বিডিপিএর প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, “যদি কমিশন প্রয়োজন মনে করে, সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি করাও যেতে পারে। তবে অনুপাত অবশ্যই ১:৪ এর মধ্যে রাখতে হবে।”
অষ্টম পে-স্কেলের সীমাবদ্ধতা
২০১৫ সালে ঘোষিত অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলকে অনেকে “বৈষম্যমূলক” বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, সেখানে একই গ্রেডে কর্মরত বিভিন্ন ক্যাডার বা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতনে অযৌক্তিক পার্থক্য ছিল।
কর্মচারী ফেডারেশনের মতে, সেই বৈষম্য দূর করতেই নতুন কাঠামো দরকার। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে এই বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন, স্মারকলিপি ও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেছে, কিন্তু কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, অষ্টম পে-স্কেলে মূল্যস্ফীতি বিবেচনা না করায় কর্মচারীদের বাস্তব আয়ে পতন ঘটে। নতুন কাঠামোতে এই বিষয়টি ঠিকভাবে সমাধান করতে পারলে সরকারি খাতের মনোবল বাড়বে।
জাতীয় বেতন কমিশনের অবস্থান
গত ২৭ জুলাই সরকার নবম জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করে। কমিশন জানিয়েছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নতুন কাঠামো কার্যকর হবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, “পে-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটে রাখা হবে। লক্ষ্য হলো—আগামী বছরের শুরুতেই নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা।”
সম্ভাব্য প্রভাব ও বিশ্লেষণ
নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারী সরাসরি উপকৃত হবেন। সরকারি ব্যয় কিছুটা বাড়লেও অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তবে কেউ কেউ সতর্ক করে বলছেন, বড় অঙ্কের বেতন বৃদ্ধি হলে বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে, যা সরকারের রাজস্ব নীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। তাই পর্যায়ক্রমে কাঠামো বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বেতন কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় এখন লাখো সরকারি কর্মচারী। প্রস্তাব অনুযায়ী কাঠামো কার্যকর হলে শুধু বেতন নয়, ভাতাসমূহও নতুন করে সমন্বিত হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত অর্থনীতির বাস্তব চিত্র ও কর্মচারীদের জীবনমান—দুই দিক বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সবশেষ প্রশ্ন একটাই: ২০২৫ সালেই কি দেখা মিলবে একটি বৈষম্যমুক্ত নতুন বেতন কাঠামোর?
এম আর এম – ১৯৩১,Signalbd.com



