বিশ্ব

ইসরায়েল কি একঘরে হতে চলেছে? সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ

Advertisement

গাজা অঞ্চলে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বেড়েই চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর ফলে প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে ইসরায়েল আজ একঘরে হয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী এবং এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?

এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো বর্তমান পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপ এবং গাজা সংঘাতের প্রভাব। পাশাপাশি আলোচনা করবো ভবিষ্যতে ইসরায়েলের জন্য এটি কী অর্থ বহন করছে।

গাজা সংকট ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার পটভূমি

২০২৫ সালের প্রথমার্ধে গাজা অঞ্চলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার উত্তেজনা তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গাজায় সামরিক অভিযান চালিয়ে ইসরায়েল হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহতের পাশাপাশি ব্যাপক মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকটের কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গাজায় সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে একটি বড় দাগ কাটেছে গাজার একটি ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি বোমা হামলা। এতে প্রাণহানির ঘটনায় ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও সরব হয়েছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ জনগণও গাজা পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা করছে।

আন্তর্জাতিক চাপ ও দ্য হেগ গ্রুপের ভূমিকা

দ্য হেগ গ্রুপ, একটি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় জোট, সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই জোটের সদস্যরা দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া ও সেনেগালসহ মোট আটটি দেশ।

এই গ্রুপের লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা করা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা। তারা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ও আইনি সহযোগিতার মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।

২০২৫ সালের জুলাই মাসে কলম্বিয়ার বোগোটা শহরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রায় ৩০টি দেশ অংশ নেয়, যেখানে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেসকা আলবানিজ উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই বৈঠককে গত ২০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে অভিহিত করেন।

এরপর ১২টি দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়, যার মধ্যে রয়েছে:

  • ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধকরণ
  • অস্ত্র বহনকারী জাহাজের চলাচলে বাধা প্রদান
  • ইসরায়েলি দখলদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারি চুক্তি পুনর্বিবেচনা

পশ্চিমা দেশের নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনা

ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা ক্রমবর্ধমান। স্লোভেনিয়া কট্টরপন্থী দুই ইসরায়েলি মন্ত্রী—ইতামার বেন-গভির এবং বেজালেল স্মোট্রিচ—কে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়েও এই দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা যৌথ বিবৃতিতে গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের ওপর জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য পরে কিছু ইহুদি বসতি নির্মাণকারী সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করে।

তুরস্কও গাজার মানবিক অবস্থা উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচার এবং আইসিজের ভূমিকা

২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে। এর পরে কলম্বিয়া, চিলি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও তুরস্ক দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন জানিয়েছে।

আইসিজের ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের অস্থায়ী রায়ে বলা হয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার সম্ভাব্য ভিত্তি’ রয়েছে এবং তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়। তবে ইসরায়েল এ নির্দেশনা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং গাজার ওপর অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

ধর্মীয় নেতাদের প্রতিবাদ ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের বোমা হামলায় গাজার হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক গির্জায় তিনজন নিহত হওয়ার পর জেরুজালেমের লাতিন প্যাট্রিয়ার্ক আর্চবিশপ পিয়েরবাত্তিস্তা পিৎজাবাল্লা ও গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ক তৃতীয় থিওফিলস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ চলছে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।

বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জরিপে ইসরায়েলের প্রতি ইতিবাচক ভাবনা কমে গেছে। বিশেষ করে মার্কিন মিডিয়া সিএনএনে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৩% আমেরিকান মনে করছেন গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপ ‘সম্পূর্ণ ন্যায্য’। ২০২৩ সালের তুলনায় এটি এক বিরাট পতন।

এই বিরোধিতা বিভিন্ন সংগীত ও সাংস্কৃতিক উৎসবেও প্রতিফলিত হচ্ছে। জার্মানির ফিউশন ফেস্টিভ্যাল, পোল্যান্ডের ওপেন’আর ফেস্টিভ্যাল ও যুক্তরাজ্যের গ্লাস্টোনবেরি ফেস্টিভ্যালে শিল্পী ও দর্শকরা গাজা যুদ্ধের নিন্দা জানিয়েছেন।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন

গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ ইসরায়েলের ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। ‘স্ট্যান্ডিং টুগেদার’ নামের একটি সংগঠন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের একত্রিত করে শান্তি ও মানবাধিকার সমর্থনে কাজ করছে।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক লাখেরও বেশি ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনা যুদ্ধ দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেও যুদ্ধবিরোধী বার্তা ছড়াচ্ছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও প্রভাব

নেতানিয়াহুর সরকার কট্টরপন্থী হলেও গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রস্তাবে গাজার পুরো জনগণকে একটি ‘মানবিক শহরে’ আটকে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা তীব্র হয়েছে, যাকে অনেকেই ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলের প্রধান কূটনৈতিক ও সামরিক সহযোগী হিসেবে রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘে ইসরায়েলের পক্ষে ভেটো দেয়, সামরিক সাহায্য জোগায় এবং আইসিসির মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

তবে আন্তর্জাতিক একঘরে পড়ার ফলে ইসরায়েলের জন্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট আরও কঠিন হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

গাজা সংকট ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং দেশটি একঘরে পড়ার পথে রয়েছে। পশ্চিমা ও গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশই কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিচার থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে ইসরায়েলের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অবশ্য ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সম্পর্ক এখনো টেকসই, যা আপাতত দেশটিকে সামরিক ও কূটনৈতিক রক্ষাকবচ প্রদান করছে। তবে বিশ্বমঞ্চে ক্রমবর্ধমান একঘরাও পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসরায়েলের ভবিষ্যত কূটনৈতিক অবস্থানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কীভাবে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক একঘরে পড়ছে?

  • আস্তে আস্তে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনা
  • দ্য হেগ গ্রুপসহ গ্লোবাল সাউথের জোরালো পদক্ষেপ
  • আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
  • ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিবাদ
  • বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাব বৃদ্ধি
  • ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের উত্থান
মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button