
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলায় হেফাজতে থাকা ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। বুধবার (২২ অক্টোবর) সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাঁদের ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এই মামলাগুলোতে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টিএফআই-জেআইসি (TFI-JIC) সেল এর অধীনে গুম, খুনসহ নানা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে এই মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
১৫ সেনা কর্মকর্তার কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ
বুধবার সকালে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করা হয়। শুনানির সময় তাঁরা সবাই জামিনের আবেদন করেন, তবে ট্রাইব্যুনাল তাঁদের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
ট্রাইব্যুনাল–১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার এর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন।
এই প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জামাল উদ্দিন ও বিচারপতি ফারহানা ইয়াসমিন। শুনানি শেষে আদালত বলেন,
“অভিযুক্তরা গুরুতর অপরাধে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো।”
দুই মামলায় মোট ৩০ জন আসামি, শেখ হাসিনার নামও রয়েছে তালিকায়
দুটি মামলায় মোট ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে এক মামলায় ১৭ জন এবং অপর মামলায় ১৩ জনের নাম রয়েছে।
দুটো মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্ষমতাসীন অবস্থায় বিশেষ সেল “TFI-JIC” ব্যবহার করে সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের গুম ও খুনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময়ে কয়েকটি নিরাপত্তা সংস্থা যৌথভাবে “অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কার্যক্রম” পরিচালনা করলেও, বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তারা কারা?
অভিযোগ অনুযায়ী, বর্তমানে হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত, কয়েকজন বর্তমানে বহিষ্কৃত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান,
“অভিযুক্তদের অনেকেই আগে থেকেই সেনা গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে জিজ্ঞাসাবাদে ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে এখন তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।”
অভিযুক্ত কর্মকর্তারা আদালতে তাঁদের আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁরা ‘রাষ্ট্রীয় নির্দেশে দায়িত্ব পালন’ করেছেন, কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ করেননি।
রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের আগে থেকেই রাজধানীজুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ভোর থেকেই হাইকোর্টের মাজারগেট, মৎস্য ভবন, কাকরাইল, বিজয়নগর ও শান্তিনগর এলাকাসহ ট্রাইব্যুনালসংলগ্ন স্থানে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির বিপুল সদস্য মোতায়েন ছিল।
ট্রাইব্যুনাল ভবনের চারপাশে চেকপোস্ট ও তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সন্দেহভাজনদের তল্লাশি শেষে আদালত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
সকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে সাংবাদিকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। সাধারণ মানুষেরও উপস্থিতি দেখা যায়, তবে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে পুরো এলাকা ছিল নিয়ন্ত্রিত।
অভিযোগের পটভূমি: TFI-JIC সেলের কার্যক্রম
“TFI-JIC (Task Force for Interrogation – Joint Interrogation Cell)” গঠিত হয় ২০০৯ সালে। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, এর উদ্দেশ্য ছিল “রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড” তদন্ত করা।
কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, এই সেলটি ব্যবহার করা হয়েছিল “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে নিশ্চুপ করতে”।
২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রায় ৩০০-র বেশি ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে গুম বা নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাও ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (UNHRC) কয়েক দফা বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছিল।
মামলার তদন্তে যা উঠে এসেছে
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি বিশেষ তদন্ত দল এই দুই মামলা পুনরায় পর্যালোচনা করে।
সেখানে প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ, ফোন রেকর্ড, অফিসিয়াল নথি এবং সাক্ষ্য জমা দেওয়া হয়।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন,
“প্রমাণগুলো থেকে বোঝা যায়, অভিযুক্তদের কেউ কেউ গোপন আটক কেন্দ্র ‘বনানী সেফ হাউজ’ ও ‘বেইলি রোড অপারেশন অফিস’-এ কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।”
এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘TFI-JIC’-এর কার্যক্রম তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিল।
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশেদুল ইসলাম বলেন,
“আমরা আদালতে পর্যাপ্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। এই কর্মকর্তারা কেবল দায়িত্ব পালন করেননি, বরং তাঁরা আইন ও মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। গুম, খুন ও নির্যাতনের মতো কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ।”
তিনি আরও বলেন,
“ট্রাইব্যুনালের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রতিফলন।”
অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবীর দাবি
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পক্ষে আইনজীবী মেজর (অব.) আনিসুর রহমান জানান,
“এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের নির্দেশে কাজ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
তিনি বলেন,
“যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাঁরা ছিলেন। গুম বা খুনের কোনো নির্দেশ তাঁরা দেননি।”
আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের কাছে জামিনের আবেদন করেন, কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দেন।
ট্রাইব্যুনালের পরবর্তী কার্যক্রম
ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, আগামী মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন শুনানি শুরু হবে।
তখন প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ ও সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং কয়েকজন সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
এই রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই এটিকে “বিচারের নতুন অধ্যায়” বলে মন্তব্য করেছেন, আবার কেউ কেউ একে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” হিসেবে দেখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিমা রহমান বলেন,
“এই ধরনের মামলা বিচারপ্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। তবে যদি সত্যিই মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ থাকে, তাহলে বিচার অবশ্যই হতে হবে।”
অন্যদিকে এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“এটা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। আদালতকে প্রমাণভিত্তিক রায় দিতে হবে।”
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
১৫ সেনা কর্মকর্তার কারাবাসের নির্দেশ শুধু একটি মামলার সিদ্ধান্ত নয়—এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য এক নতুন মোড়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিরল ঘটনা। এ ধরনের মামলায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা রাষ্ট্রের জন্য বড় পরীক্ষা।
সবশেষে আদালত জানিয়েছে,
“বিচার হবে আইনের ভিত্তিতে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নয়।”
সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ:
- মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৫ সেনা কর্মকর্তা কারাগারে
- দুই মামলায় মোট ৩০ জন আসামি, শেখ হাসিনার নামও রয়েছে
- রাজধানীতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- রাষ্ট্রপক্ষ ও প্রতিরক্ষা উভয়েরই তীব্র যুক্তি
- আগামী মাসে অভিযোগ গঠন শুনানি
MAH – 13418 I Signalbd.com