বাংলাদেশ

বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ দেশে বাড়ছে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা

Advertisement

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও, সম্প্রতি একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এক ইউনিটের পর আরেক ইউনিট বন্ধ

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক জানান, কেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটটি রোববার রাতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো কেন্দ্রটি এখন উৎপাদনশূন্য। এর আগে গত ১৬ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যায় ২৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষম তৃতীয় ইউনিটটি। ফলে বর্তমানে কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের কোনোটিই চালু নেই।

প্রধান প্রকৌশলী বলেন,

“এক ও তিন নম্বর ইউনিটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ টিম কাজ শুরু করেছে। আশা করছি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মেরামত শেষে পুনরায় উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হবে।”

দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর একটি। এটি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির পাশে স্থাপন করা হয়েছে। এখানকার কয়লা দিয়েই কেন্দ্রটির তিনটি ইউনিট চালানো হয়।

প্রথম ইউনিটটি (১২৫ মেগাওয়াট) ২০০৬ সালে উৎপাদন শুরু করে। দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০১১ সালে চালু হয়, আর তৃতীয়টি ২০১৮ সালে যুক্ত হয় জাতীয় গ্রিডে। তবে ২০২০ সালের পর থেকে প্রথম ইউনিটটি প্রায়ই যান্ত্রিক সমস্যায় ভুগছে, যা এখনও পুরোপুরি মেরামত হয়নি।

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণ কী?

কেন্দ্রের প্রকৌশল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো যন্ত্রাংশ, সীমিত রক্ষণাবেক্ষণ, এবং মানসম্মত খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিছু অংশে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিকল হয়ে গেছে, আবার কিছু ইউনিটে বয়লার সমস্যা দেখা দিয়েছে।

একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,

“বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে তা সময়মতো করা যাচ্ছে না।”

বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রভাব

বড়পুকুরিয়া থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় দেশের উত্তরাঞ্চলে ইতিমধ্যেই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী অঞ্চলে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন,

“প্রতিদিন অন্তত তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। রাতে গরমে ঘুমানোই দায় হয়ে উঠেছে।”

অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে মিল ও কারখানাগুলোর ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন।

সরকারি পর্যায়ে উদ্বেগ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বড়পুকুরিয়া কেন্দ্র বন্ধ থাকায় জাতীয় গ্রিডে কমপক্ষে ৪০০ মেগাওয়াট ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে অন্যান্য তাপবিদ্যুৎ ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছে।

পিডিবির কর্মকর্তার ভাষায়,

“আমরা বিকল্প হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলের গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি টেকসই সমাধান নয়।”

কয়লার সরবরাহ ও খনির সংকট

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উত্তোলিত কয়লাই এই কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি। কিন্তু কয়লা উৎপাদনেও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে খনির উৎপাদন কমে গেছে, পাশাপাশি শ্রমিক সংকট, যন্ত্রপাতি জীর্ণতা ও নীতিগত সমস্যার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, কয়লাখনি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র—দুটি প্রতিষ্ঠানই যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, তবে এরকম বিপর্যয় ঘন ঘন ঘটবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে জাতীয় চিত্র

বাংলাদেশ বর্তমানে মোট ২৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু বাস্তবে উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ১৩,০০০ থেকে ১৫,০০০ মেগাওয়াট। এর বড় একটি অংশ নির্ভর করছে গ্যাস ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রের ওপর, যা ব্যয়বহুল ও জ্বালানি সংকটে পড়ছে প্রায়ই।

তাই সরকার কয়েক বছর ধরেই কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোকে টেকসই বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু বড়পুকুরিয়া ও পায়রা কেন্দ্রের পুনঃপুন সমস্যায় সেই আশা ধীরে ধীরে ম্লান হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন,

বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা সীমিত। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, দক্ষ জনবল প্রশিক্ষণ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই ধরনের কেন্দ্র টেকসই হয় না।”

তিনি আরও বলেন,

“যদি বড়পুকুরিয়ার মতো কেন্দ্রগুলো সময়মতো সংস্কার না করা হয়, তবে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ঘাটতিও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।”

আগামী দিনের সম্ভাবনা

কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের একটি বিশেষজ্ঞ দল ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের ত্রুটি নির্ণয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে নতুন যন্ত্রাংশ আমদানি করা হবে।

তারা আশা করছেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই অন্তত একটি ইউনিট চালু করা সম্ভব হবে। যদি তা হয়, তাহলে আংশিক উৎপাদন পুনরায় শুরু করা যাবে এবং জাতীয় গ্রিডে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরবে।

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবে আজ সেটি স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

শুধু ত্রুটি মেরামত নয়—এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি পরিকল্পনা, যেখানে কয়লা, গ্যাস ও নবায়নযোগ্য শক্তি সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গড়ে তোলা হবে। তা না হলে বড়পুকুরিয়ার মতো সংকট ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

MAH – 13405 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button