
বাংলাদেশে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সক্রিয়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কমিশন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ রবিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে নির্বাচন কমিশন।
সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হওয়া এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের চারজন কমিশনার, ইসির সচিব, এবং বিভিন্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবসহ তিন বাহিনীর প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি, বিজিবি, র্যাব, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক, এনটিএমসি, এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকসহ মোট ১৮ জন শীর্ষ কর্মকর্তা অংশ নেন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকারে ঐকমত্য
বৈঠকের শুরুতেই সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ নির্বাচন নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আমাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে ভোটাররা নিরাপদে, নির্ভয়ে ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারেন।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন চায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
নিরাপত্তা পরিকল্পনায় গুরুত্ব
বৈঠকে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানান, নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য ইতিমধ্যে প্রাথমিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরাপত্তা টিম গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে ভোটের আগে ও পরে সহিংসতা প্রতিরোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনকালীন সময়ে মাঠ পর্যায়ে মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স ও রিজার্ভ ইউনিট মোতায়েন করা হবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও থাকবে।
বিজিবি ও আনসার বাহিনীর প্রস্তুতি
বিজিবির প্রতিনিধি জানান, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিশেষ টহল জোরদার করা হবে যাতে কোনো ধরনের অবৈধ অস্ত্র বা ব্যক্তি সীমান্ত অতিক্রম করে নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নিত করতে না পারে। বিজিবি পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বলে বৈঠকে আশ্বাস দেওয়া হয়।
অন্যদিকে আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক বলেন, গ্রামাঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা প্রথম প্রতিরক্ষা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আনসার বাহিনী ইতোমধ্যে প্রায় দুই লাখ সদস্যকে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত রেখেছে।
ইসির নির্দেশনা ও প্রত্যাশা
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই নির্বাচন হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বচ্ছ। ইভিএম ব্যবহারের পাশাপাশি ভোটগ্রহণের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। কমিশন প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কমপক্ষে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা করছে।
সিইসি বলেন, “আমরা চাই না কোনো ভোটার ভয়ে কেন্দ্রে না যান। মানুষ যেন নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন—সেই পরিবেশ নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
প্রস্তুতি সভার পটভূমি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও পর্যবেক্ষক সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। এই ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আজকের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আগের বৈঠকগুলোতে ইসি নির্বাচনের সময়সূচি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচনী ব্যয়, আচরণবিধি এবং মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। এবার মূলত নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, কারণ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নিরাপত্তা বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখতে বিশেষ পদক্ষেপ
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। তাই প্রতিটি জেলার রিটার্নিং অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার জন্য।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন তারা রাজনৈতিক সহিংসতা, উস্কানি বা অপপ্রচার রোধে সক্রিয় থাকে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্তে বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হবে
এনটিএমসি ও এনএসআইয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক গুজব, অপপ্রচার এবং উস্কানিমূলক পোস্ট পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে। তারা বলছেন, ভোটের আগে ও ভোটের দিন যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা না হয়, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকবে।
সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ
ইসি জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা হবে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুলিশ, আনসার ও প্রশাসনের সদস্যরাও এই প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন। এতে দায়িত্ববোধ, আচরণবিধি ও সমন্বয় পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে।
একজন কমিশনার বলেন, “একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। এটি সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল। সবাই মিলে দায়িত্বশীলভাবে কাজ করলে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে।”
জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য
গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোটের দিন সহিংসতা, ভোটকেন্দ্রে দখল, জাল ভোট ও বিরোধীদের অভিযোগ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের নির্বাচনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ইসি সচেষ্ট।
সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা চাই জনগণ আবার নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরে পাক। নির্বাচনের ফল যেন ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়—এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি
বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে মাঠপর্যায়ে উত্তেজনা কম থাকে। তাই রাজনৈতিক সংলাপ ও পারস্পরিক সহনশীলতার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, কমিশন শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বসবে এবং নির্বাচনী আচরণবিধি ও প্রচারণার নিয়মাবলি নিয়ে আলোচনা করবে।
ভোটের দিন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিন ধাপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
- প্রথম ধাপে কেন্দ্রের আশপাশে আনসার বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।
- দ্বিতীয় ধাপে পুলিশ ও র্যাবের টহল টিম থাকবে।
- তৃতীয় ধাপে বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর স্ট্যান্ডবাই ফোর্স থাকবে, প্রয়োজনে দ্রুত হস্তক্ষেপের জন্য।
প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
ভোটারদের প্রতি আহ্বান
বৈঠক শেষে সিইসি জনগণের উদ্দেশে বলেন, “নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব। আমরা সবাই চাই এটি যেন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। আমি ভোটারদের অনুরোধ করছি, ভয়ের কোনো কারণ নেই—নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যান এবং আপনার ভোট দিন।”
তিনি আরও যোগ করেন, নির্বাচন কমিশন প্রতিটি ভোটের মর্যাদা রক্ষায় বদ্ধপরিকর।
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের এই বৈঠক শুধু প্রশাসনিক প্রস্তুতির বিষয় নয়, বরং এটি একটি বার্তা—ইসি নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশজুড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়লেও কমিশনের এই উদ্যোগ জনগণের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “নির্বাচন কমিশনের উচিত মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান কার্যক্রম বাড়ানো। শুধু বৈঠক নয়, বাস্তব পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে।”
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগই নির্ধারণ করবে এই নির্বাচনের সাফল্য। আজকের বৈঠক সেই লক্ষ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ভোটারদের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
MAH – 13398 I Signalbd.com