বাংলাদেশ

অগ্নিসংযোগের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার

Advertisement

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগ বেড়েছে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—এসব দুর্ঘটনা কি কেবলই দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো সংগঠিত নাশকতা?

এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শনিবার এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে। এতে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, যদি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সরকার কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না

বিবৃতিটি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, সরকারের কাছে দেশের মানুষের উদ্বেগ ও আতঙ্কের বিষয়টি পুরোপুরি জানা আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে প্রতিটি ঘটনার ওপর বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে এবং প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সরকারি বিবৃতিতে আরও বলা হয়—

“মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে। ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মকাণ্ড বা ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জাতীয় নিরাপত্তা ও ঐক্যের বার্তা

সরকারের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, কেউ যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, তবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
বিবৃতিতে বলা হয়—

“আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, যদি এসব অগ্নিকাণ্ড নাশকতা বা আতঙ্ক সৃষ্টির কৌশল হিসেবে পরিচালিত হয়ে থাকে, তবে তারা সফল হবে কেবল তখনই, যদি আমরা ভয়কে আমাদের ঐক্য ও যুক্তির ওপর প্রাধান্য নিতে দিই।”

সরকার জনগণকে শান্ত, সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি, গুজব বা ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকারও অনুরোধ করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো

গত কয়েক সপ্তাহে দেশজুড়ে যেসব বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার মধ্যে অন্তত চারটি ঘটনা বিশেষভাবে দৃষ্টি কেড়েছে।

১. শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

শনিবার দুপুরে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কয়েক ঘণ্টা পরও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, দুপুর ১২টার দিকে আগুন লাগে কার্গো এলাকার একটি গুদামে। সেখানে প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও বিপুল পরিমাণ পণ্য ও কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা।

২. চট্টগ্রাম ইপিজেডে শিল্প কারখানায় আগুন

এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) একটি গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৭ ঘণ্টা লেগে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেখানে দাহ্য কাপড় ও কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে কারখানার বিশাল অংশ পুড়ে যায় এবং কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং অগ্নিকাণ্ডের উৎস খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

৩. টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে সূতার মিলে আগুন

বৃহস্পতিবার রাতেই টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার একটি সূতার মিলে আগুন লাগে। আগুনে পুরো মিলটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, রাতে হঠাৎ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং মুহূর্তেই কারখানার ভেতরের মেশিন ও মালামাল ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে তদন্ত কমিটি বলছে, কোনো ধরনের নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

৪. মিরপুরে কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড

এরও আগে ১৪ অক্টোবর, ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে ঘটে যায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। একটি কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় লাগা আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন আরও অনেকে।
ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, ভবনটিতে একাধিক কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ ছিল। বিস্ফোরণের শব্দে আশপাশের এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে ঘটনাটি নিয়ে নাশকতার সন্দেহে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ।

জনমনে প্রশ্ন ও সরকারের জবাব

একটির পর একটি অগ্নিকাণ্ডে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে—এসব কি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিকাণ্ড কিছুটা বেড়ে যায়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে একই সময়সীমায় বড় বড় স্থাপনায় ধারাবাহিক আগুন লাগা উদ্বেগজনক।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ভবন, নিরাপত্তাহীন গুদাম ও পুরোনো তারের সংযোগ দায়ী হতে পারে। তবে সবগুলো ঘটনায় একই সময়ে বড় পরিসরে অগ্নিকাণ্ড হওয়ায় অনেকেই এটিকে সন্দেহজনক বলে মনে করছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণের এ উদ্বেগ অমূলক নয়। তাই প্রতিটি ঘটনাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে’ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের জন্য আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‍্যাব এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা যৌথভাবে কাজ করছেন।
একই সঙ্গে কারখানা মালিক ও স্থানীয় প্রশাসনকে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরও কঠোরতা আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যদি তদন্তে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এসব অগ্নিকাণ্ড ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয়েছে, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ কঠোর ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাগরিকদের প্রতি আহ্বান

বিবৃতিতে জনগণকে শান্ত ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।
সরকার বলেছে—

“যে কোনো গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে কেউ যেন আতঙ্ক সৃষ্টি না করে। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই; সরকার এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।”

সরকারি সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা নিজে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মানবিক বিপর্যয়

অগ্নিকাণ্ড শুধু প্রাণহানি নয়, দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা দিয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার শিল্প এলাকায় আগুনে পুড়ে গেছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও তৈরি পোশাক।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তাছাড়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড রপ্তানি খাতের ভাবমূর্তিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত, দ্রুত কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

দেশব্যাপী নজরদারি জোরদার

নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব শিল্পাঞ্চল, বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে।
সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, এবং প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর সহায়তাও নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে একটি দায়িত্বশীল সূত্র।

সচেতনতার বার্তা

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও জনগণকে সচেতন থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা বলছেন, অনেক সময় ছোট্ট অবহেলা বড় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। তাই অফিস, কারখানা ও ঘরে অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম রাখা এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সতর্ক থাকা জরুরি।

বাংলাদেশ আজ এক কঠিন সময় পার করছে—প্রতিদিনের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা শ্রমজীবী মানুষগুলো বারবার আগুনে সব হারাচ্ছে।
তবুও সরকারের ঘোষণা ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এই বার্তা দিচ্ছে—
দেশে অরাজকতা বা নাশকতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই
যদি কেউ পরিকল্পিতভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে, তবে আইন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে—এটাই সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার।

MAH – 13384 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button