
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মোটরযানে অননুমোদিত হর্ন, বিশেষ করে হাইড্রোলিক হর্ন, বহুসুরের হর্ন ও হুটার ব্যবহার। এই হর্নগুলোর বিকট ও কর্কশ শব্দ শুধু শ্রবণশক্তির ক্ষতি করে না, বরং মানুষের মানসিক শান্তি নষ্ট করে, সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।
এবার এই সমস্যার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
বিআরটিএর নির্দেশনা: অননুমোদিত হর্ন অপসারণে কঠোর ব্যবস্থা
বিআরটিএ সম্প্রতি এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা দিয়েছে, দেশের সব ধরনের মোটরযান থেকে অননুমোদিত হুটার, হাইড্রোলিক হর্ন এবং অন্যান্য বহুসুরের হর্ন অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এসব হর্ন ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। যদি কেউ নির্দেশনা অমান্য করে এসব হর্ন ব্যবহার অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এর ৮১ নম্বর বিধি অনুযায়ী শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় জরুরি সেবা যেমন—অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নিনির্বাপক যান, উদ্ধারযান ও পুলিশের নির্দিষ্ট যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো মোটরযানে বিকট, কর্কশ, বহুসুরের বা আতঙ্কসৃষ্টিকারী শব্দ উৎপাদনকারী হর্ন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কেন নিষিদ্ধ হচ্ছে হাইড্রোলিক ও বহুসুরের হর্ন
হাইড্রোলিক ও বহুসুরের হর্ন সাধারণত আমদানি করা ট্রাক, বাস ও পণ্যবাহী যানবাহনে বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব হর্নের শব্দমাত্রা ১১০ ডেসিবেল বা তারও বেশি হয়ে থাকে, যা মানুষের সহনক্ষমতার বাইরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত এসব হর্নের আওয়াজে কানে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। অনেক সময় উচ্চ শব্দের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে, কারণ চালক ও পথচারী উভয়েই ভয় পেয়ে হঠাৎ প্রতিক্রিয়া দেখান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“শব্দদূষণ এখন বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে তিনগুণ বেশি। এতে শুধু শ্রবণশক্তিই নয়, মানসিক চাপ, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অনিদ্রা ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।”
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় হর্ন নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব
শব্দদূষণকে এখন ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। অনেকেই জানেন না, প্রতিদিন রাস্তার এই বিকট শব্দ তাদের শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৫ ডেসিবেলের ওপরে শব্দে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে মানুষের শ্রবণক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ঢাকার বিভিন্ন সড়কে হর্নের শব্দ ১০০ থেকে ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়, যা সরাসরি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে।
শুধু তাই নয়, শব্দদূষণ শিশু ও বয়স্কদের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। শিশুদের পড়াশোনার মনোযোগ কমে যায়, ঘুমের সমস্যা হয় এবং তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা ও উদ্বেগ বেড়ে যায়।
বিআরটিএর অভিযান ও মনিটরিং ব্যবস্থা
বিআরটিএ জানিয়েছে, হর্ন নিয়ন্ত্রণে তারা বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করছে। এই টিম নিয়মিতভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালাবে।
যেসব যানবাহনে হাইড্রোলিক বা বহুসুরের হর্ন পাওয়া যাবে, সেসব যানবাহনের মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক জরিমানা এবং প্রয়োজনে মামলা করা হবে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন,
“আমরা ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। আমাদের লক্ষ্য শুধু জরিমানা নয়, চালকদের সচেতন করা। সবাই যদি বুঝে হর্নের ক্ষতি কতটা ভয়াবহ, তাহলে নিজেরাই এ অভ্যাস ছাড়বেন।”
পুলিশ ও পরিবহন মালিক সমিতির সহযোগিতা
শুধু বিআরটিএ নয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোও এই অভিযানে সহযোগিতা করছে।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা নিয়মিতভাবে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারী যানবাহন আটক করছি। অনেক সময় দেখা যায়, চালকরা হর্নের শব্দকে ‘স্টাইল’ মনে করেন। কিন্তু এটি আইনের লঙ্ঘন এবং জনগণের ভোগান্তির কারণ।”
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একজন প্রতিনিধি বলেন,
“আমরা আমাদের চালক ও মালিকদের বারবার বলেছি, এসব হর্ন ব্যবহার বন্ধ করতে। যারা আইন মানবে না, তাদের যানবাহন আমরা নিজেরাই স্ট্যান্ড থেকে বের হতে দেব না।”
অভিযানে জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, শুধু সরকারি নির্দেশনা নয়, জনগণের সচেতনতাও জরুরি। সাধারণ মানুষ যদি এসব হর্ন ব্যবহারকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান, তাহলে আইন প্রয়োগ আরও কার্যকর হবে।
বিআরটিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যেকোনো নাগরিক হর্নবিরোধী অভিযোগ সরাসরি সংস্থার অফিস বা হেল্পলাইন নম্বরে জানাতে পারেন।
ঢাকার এক বাসিন্দা বলেন,
“প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে গিয়ে যে শব্দদূষণ শুনি, তা ভয়াবহ। সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। যদি সরকার সত্যিই এসব বন্ধ করতে পারে, তাহলে এটি বড় একটি স্বস্তির বিষয় হবে।”
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনি কাঠামো
বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬। এই আইনে শব্দের নির্ধারিত সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে —
- শান্ত এলাকা: ৫০ ডেসিবেল
- আবাসিক এলাকা: ৫৫ ডেসিবেল
- বাণিজ্যিক এলাকা: ৭০ ডেসিবেল
- শিল্প এলাকা: ৭৫ ডেসিবেল
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ এলাকাতেই এই সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিশেষ করে যানবাহনের হর্নই শব্দদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস। তাই বিআরটিএর এই পদক্ষেপকে বিশেষজ্ঞরা সময়োপযোগী বলছেন।
আধুনিক সাইলেন্ট হর্ন ব্যবহারের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব যানবাহনের জন্য হর্ন অপরিহার্য, তারা চাইলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সাইলেন্ট হর্ন বা ইলেকট্রনিক হর্ন ব্যবহার করতে পারে। এসব হর্নের শব্দ তীব্র নয়, বরং সীমিত মাত্রার এবং দূষণমুক্ত।
এছাড়া যানবাহনের নিয়মিত সার্ভিসিং ও সাইলেন্সার সিস্টেম ঠিক রাখলে হর্নের প্রয়োজনও অনেক কমে যায়।
সচেতনতার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব
যদি চালক, মালিক ও সাধারণ মানুষ একসাথে উদ্যোগ নেয়, তাহলে অননুমোদিত হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমেরও এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। স্কুলে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে শব্দদূষণের ক্ষতি সম্পর্কে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সচেতন হয়।
বিআরটিএর এই উদ্যোগ শুধুমাত্র আইনি প্রয়োগ নয়, এটি বাংলাদেশের সড়ক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা।
যদি এই নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে শুধু সড়কের শব্দ কমবে না, বরং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটবে।
অতএব, এখনই সময়—আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই অননুমোদিত হর্নমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।
MAH – 13373 I Signalbd.com