বাংলাদেশ

ফরিদপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেল বাজারের ১৫ দোকান

Advertisement

ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ব্যস্ত কাদিরদী বাজারে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মুহূর্তের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অন্তত ১৫টি দোকান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, শনিবার গভীর রাতে হঠাৎ করে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে বাচ্চু মোল্লার মার্কেট এলাকায়। আগুনের উৎস হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট।

রাতের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ আগুন দেখা দিলে পুরো বাজারে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। প্রথমে মার্কেটের একটি টেইলার্সের দোকান থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন লেলিহান শিখায় ছড়িয়ে পড়ে পাশের মুদি দোকান, জুতার দোকান, ফার্মেসি, মোবাইলের দোকান এবং বিভিন্ন ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানজুড়ে। স্থানীয়রা পানি ও বালতি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তা নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন।

ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা

খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বোয়ালমারী ও মধুখালী ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জানান, আগুন লাগার সময় দোকানগুলো বন্ধ ছিল, ফলে কেউ হতাহত না হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিপুল পরিমাণে।

প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, আগুনে অন্তত ৫০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক দোকানে নতুন পণ্য এসেছিল।

ব্যবসায়ীদের আহাজারি

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যখন আগুন পুরোপুরি নিভে যায়, তখন দেখা যায় এক ভয়াবহ দৃশ্য। দোকানগুলোর জায়গায় শুধু ছাই, পোড়া লোহা আর ভস্মস্তূপ। ব্যবসায়ীরা চোখের সামনে তাদের জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে হতবাক হয়ে যান। কেউ কেউ কান্না করছিলেন, কেউবা পোড়া দোকানের সামনে বসে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোহেল বলেন, “আমার জুতার দোকানটা ছিল ছোট, কিন্তু পুরো পরিবার এই দোকানের আয় দিয়েই চলে। সব শেষ হয়ে গেছে। গত সপ্তাহেই নতুন পণ্য এনেছিলাম, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।”

আরেক ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, “রাতে খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছিলাম, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। আগুন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, চোখের সামনে দোকান পুড়ে গেল। এখন আমি পথে বসে গেছি।”

স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা

অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ইউএনও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। জেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”

তদন্ত কমিটি গঠন

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে জানা যাবে আগুনের উৎস, ক্ষতির পরিমাণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা শর্ট সার্কিটকে কারণ হিসেবে দেখছি, তবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করছি বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যবস্থায় সচেতনতা বাড়াতে।”

এলাকাবাসীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা

যখন আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন এলাকার তরুণরা ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন। অনেকে দোকানের তালা ভেঙে ভেতরের পণ্য উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। কিছু দোকান থেকে অল্প কিছু মালামাল বের করতে সক্ষম হন তারা। তাদের এই মানবিক উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

স্থানীয় যুবক রফিকুল ইসলাম বলেন, “ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আমরা পানি দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আগুন এত দ্রুত ছড়ায় যে কিছুই করা যায়নি। তবে আমরা একে অপরকে সাহায্য করেছি, যাতে কেউ আহত না হয়।”

বৈদ্যুতিক নিরাপত্তায় অবহেলা

স্থানীয়দের মতে, কাদিরদী বাজারে বেশ কয়েকটি পুরনো ভবনে তারের সংযোগ দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট অবস্থায় ছিল। ব্যবসায়ীরা অনেক সময় নিজেরাই বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক করতেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের অনেক বাজারেই একই সমস্যা রয়েছে।

তারা বলেন, “যেসব মার্কেটে পুরনো তার ও অনিয়ন্ত্রিত সংযোগ রয়েছে, সেখানে নিয়মিত পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। অন্যথায় এ ধরনের দুর্ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।”

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা দাবি

অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, এই আগুনে তাদের জীবনের পুঁজি শেষ হয়ে গেছে। অনেকের দোকান ছিল একমাত্র জীবিকার উৎস। দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হলে পরিবার চালানো কষ্টকর হবে।

স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “এই ব্যবসায়ীরাই বাজারের প্রাণ। তাদের পাশে না দাঁড়ালে কাদিরদী বাজার আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে না। আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, যাতে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সহায়তা দেওয়া হয়।”

এলাকার অর্থনৈতিক প্রভাব

কাদিরদী বাজার বোয়ালমারী উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন এই বাজারে আসেন কেনাকাটার জন্য। আগুনে বাজারের মূল অংশ পুড়ে যাওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। বাজারটি পুনর্গঠনের কাজ না হলে বহু মানুষের জীবিকা ব্যাহত হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গ্রামীণ বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্নিকাণ্ড কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বড় প্রভাব ফেলে। ছোট ব্যবসায়ীরা পুনরায় ব্যবসা শুরু করতে সময় ও মূলধন—দুটিই হারান, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

পুনর্গঠন পরিকল্পনা

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, বাজারের পুনর্গঠনের জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। নতুন করে দোকান নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা মান বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। বৈদ্যুতিক লাইন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও নির্গমন পথের উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে।

বোয়ালমারী উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা চাই ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে। এজন্য মার্কেটের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। আগুন প্রতিরোধে সচেতনতা কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হবে।”

জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি

অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনাটি স্থানীয়দের মধ্যে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এখন নিজের দোকান বা বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা করছেন। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, তারা চাইলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে প্রস্তুত।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলেন, “আগুন লাগার পর সবাই দৌড়ায়, কিন্তু আগে থেকে প্রস্তুতি থাকলে ক্ষতি অনেকটা কমানো যায়। আমরা চাই সবাই আগুন প্রতিরোধে সচেতন হোক।”

সমবেদনা ও সহমর্মিতা

অগ্নিকাণ্ডের খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় তরুণ সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে। অনেকে পোশাক, খাবার ও নগদ অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন।

একজন তরুণ স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “এই মানুষগুলো আমাদের সমাজের অংশ। তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। ছোট একটি সাহায্যও যদি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, সেটিই বড় সান্ত্বনা।”

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী বাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে—অবহেলা ও অসতর্কতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। একটি ছোট শর্ট সার্কিট মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারে বহু বছরের পরিশ্রম।

আগুনে পুড়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের চোখে এখন শুধু শূন্যতা। তবে প্রশাসনের উদ্যোগ, স্থানীয়দের সহানুভূতি ও সহযোগিতা যদি একত্রে কাজ করে, তবে হয়তো তারা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের জন্য এক গভীর শিক্ষা—আগুন প্রতিরোধে সচেতনতা ও প্রস্তুতিই একমাত্র সুরক্ষা।

MAH – 13372 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button