
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুরো বিমানবন্দরের রানওয়ে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটার দিকে আগুন লাগার পর থেকে বিমানবন্দরে নেমে এসেছে কার্যত অচলাবস্থা। বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত রানওয়ে বন্ধ থাকবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
অগ্নিকাণ্ডের ফলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক— উভয় রুটের ফ্লাইট চলাচলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে ঢাকায় অবতরণ না করে বিকল্প বিমানবন্দরে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আগুনের সূত্রপাত ও উদ্ধার অভিযান
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানায়, দুপুর সোয়া ২টার দিকে কার্গো ভিলেজ এলাকার আমদানি পণ্যের গুদামে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ২৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি ইউনিটও অভিযানে যোগ দেয়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, কার্গো ভিলেজে প্রচুর দাহ্য পদার্থ, কাপড় ও কেমিক্যাল মজুদ থাকায় আগুন দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এখন পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে।
এই ঘটনায় আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে আনসারের অন্তত ১৭ সদস্য আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৯ জনকে সিএমএইচে এবং বাকি ৮ জনকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিমান চলাচলে বিপর্যয়, ফ্লাইট ঘুরে যাচ্ছে বিকল্প গন্তব্যে
আগুন লাগার পরপরই শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে আকাশপথে সৃষ্টি হয় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা।
হংকং থেকে ঢাকাগামী ক্যাথে প্যাসিফিকের একটি ফ্লাইট দীর্ঘ সময় আকাশে চক্কর দিতে বাধ্য হয়। দিল্লি থেকে ঢাকাগামী ইন্ডিগোর ফ্লাইট অবতরণের অনুমতি না পেয়ে কলকাতায় নামানো হয়। ব্যাংকক থেকে আসা ইউএস-বাংলার এবং শারজাহ থেকে আসা এয়ার এরাবিয়ার দুটি ফ্লাইট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।
অভ্যন্তরীণ রুটেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সৈয়দপুর ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী দুটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর পুনরায় ঘুরে যায় চট্টগ্রামে। ঢাকা থেকে মুম্বাই ও কুয়ালালামপুরগামী দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট রানওয়ে বন্ধ থাকায় ট্যাক্সিওয়েতে আটকে থাকে দীর্ঘ সময়।
ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ও ব্যবসায়িক প্রভাব
কার্গো ভিলেজের কর্মীদের দাবি, আগুনে বিপুল পরিমাণ গার্মেন্টস আইটেম, ফেব্রিকস, মেশিনারি এবং কেমিক্যাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তামিম এক্সপ্রেস লিমিটেডের পরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, “আমাদের প্রায় আড়াইটন পণ্য আজ নেমেছিল, সবই পুড়ে গেছে। সব গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ ছিল।”
বিমানবন্দরের কাস্টমস ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্টরা জানান, এই ঘটনায় কোটি টাকার পণ্যের ক্ষতি হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা করছেন, অন্তত কয়েক সপ্তাহ কার্গো কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেবে।
যাত্রীদের ভোগান্তি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
হঠাৎ রানওয়ে বন্ধ হয়ে পড়ায় শত শত যাত্রী বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন। কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন পরবর্তী নির্দেশনার জন্য। অনেকে বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পাঠানো হয়েছে।
কুয়েত, দুবাই ও দোহা থেকে ঢাকামুখী বেশ কিছু ফ্লাইট সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিমান কর্তৃপক্ষ।
একজন বিদেশগামী যাত্রী বলেন, “আমরা বিকেল থেকেই বিমানবন্দরে, কিন্তু কেউ কিছু জানায় না। বোর্ডিং শেষ, তারপরও উড়তে পারছি না।”
অগ্নিকাণ্ডের কারণ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, কেমিক্যাল বা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক মো. মাসুদুল হাসান জানান, “আগুনের প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা, কেমিক্যালের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।”
অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা ও পরবর্তী ব্যবস্থা
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাত ৯টার পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রানওয়ে চালু করা সম্ভব কি না। একই সঙ্গে কার্গো ভিলেজ এলাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, “আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা শুরু হবে না। নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অগ্নিকাণ্ড শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দেশের আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন ব্যবস্থার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মো. মাহবুবুল হক বলেন, “এই ধরনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শিডিউলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। দ্রুত তদন্ত ও পুনর্গঠন প্রয়োজন।”
শনিবার বিকেলের অগ্নিকাণ্ডে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পুরো কার্যক্রম থমকে গেছে। রাতের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি না, তা নির্ভর করছে আগুন কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে তার ওপর। তবে এই ঘটনার প্রভাব কেবল বিমানবন্দরেই নয়, পুরো আকাশপথে পড়েছে তা নিশ্চিত।
এম আর এম – ১৮২৮,Signalbd.com