
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এবং তার স্ত্রী রেহানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
দুদকের মামলার বিস্তারিত
দুদকের উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে কমিশনের ঢাকা-১ কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার দুটি মামলা দায়ের করেন।
দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাবের হোসেন চৌধুরী ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তার বৈধ আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে ১২ কোটি ২৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৬৯ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
এছাড়া, তিনি নিজের নামে ২১টি ব্যাংক হিসাবে মোট ১২৪ কোটি ৬১ লাখ ৫৪ হাজার টাকার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
দুদক জানায়, সাবের হোসেন চৌধুরীর এই সম্পদ অর্জন ও লেনদেনের ক্ষেত্রে জ্ঞাত আয় ব্যতিরেকে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
স্ত্রীর বিরুদ্ধেও পৃথক মামলা
দুদকের আরেকটি মামলায় সাবের হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী রেহানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তিনি বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই ২৬ কোটি ৯৭ লাখ ১৫ হাজার টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ে তার নামে থাকা তিনটি ব্যাংক হিসাবে মোট ১৫০ কোটি ৮৮ লাখ ৯২ হাজার টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, এসব লেনদেনের উৎস ও আর্থিক উৎস স্পষ্ট নয়, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী অপরাধের আওতায় পড়ে।
কোন আইনে মামলা করা হয়েছে
দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাবের হোসেন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলাই করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায়।
এছাড়া, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারাতেও অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন হওয়ার পর কমিশন মনে করেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। তদন্তের পর প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাবের হোসেন চৌধুরীর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা
গত অক্টোবরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই সাবের হোসেন চৌধুরীকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ।
রিমান্ডে নেওয়ার পরদিনই তিনি ছয় মামলায় জামিন পান এবং মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে কারাগার থেকে মুক্তি পান।
সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে তিন দেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠককে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। অনেকেই মনে করছেন, সাবের হোসেন চৌধুরী আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
এই প্রেক্ষাপটে দুদকের এই মামলাকে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দুদকের বক্তব্য
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, “আমাদের কাছে প্রমাণ এসেছে যে, সাবের হোসেন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, যা তাদের ঘোষিত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই আইন অনুযায়ী আমরা মামলা দায়ের করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “দুদক কখনও রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ করে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে, তার পদ বা অবস্থান নির্বিশেষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম বলেন, “দুদক যদি নিরপেক্ষভাবে এই মামলাগুলোর তদন্ত করে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে একটি মাইলফলক হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “তবে যদি এই মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হয়ে ওঠে, তাহলে এটি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
মামলার পরবর্তী পদক্ষেপ
দুদক জানিয়েছে, মামলার পরপরই তারা সম্পদের উৎস যাচাই ও ব্যাংক লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ শুরু করেছে।
বিভিন্ন ব্যাংক, ভূমি অফিস ও রেজিস্ট্রি দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তথ্য বিনিময় করা হতে পারে।
তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর চার্জশিট দাখিলের বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
সাবের হোসেন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনেকে একে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের অংশ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ বলছেন এটি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের অংশ।
তবে সবকিছু নির্ভর করছে দুদকের তদন্ত কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় তার ওপর।
এম আর এম – ১৮০৯,Signalbd.com