
খুলনা অঞ্চলে এখন আর দিন-রাতের কোনো তফাৎ নেই। যখন-তখন হঠাৎ করেই চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। ঘন ঘন এই অঘোষিত লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ঘরের ভেতর প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, আবার রাতে অন্ধকারে ঘুমানোও দায় হয়ে উঠেছে।
চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্য: বিদ্যুৎ ঘাটতি বেড়েই চলেছে
বুধবার (১৫ অক্টোবর) রাত ৮টার হিসাব অনুযায়ী, খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় মোট চাহিদা ছিল ৬৩৩ মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ পাওয়া গেছে মাত্র ৫৭৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট এবং আদানি পাওয়ারের একটি ইউনিট বন্ধ থাকায় এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে কয়লা সরবরাহে বিলম্ব ও গ্রিডে অতিরিক্ত চাপও সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
বিদ্যুৎ কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা: “সমস্যা অস্থায়ী”
খুলনা গ্রিড সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হুমায়ূন কবীর আব্বাসী বলেন,
“বিদ্যুৎ সংকট চলছে, তবে এটি স্থায়ী নয়। রামপালের দুটি ইউনিটের একটি বন্ধ ছিল, কয়লা এসেছে, সেটি আবার চালু হবে। আদানি থেকেও একটি ইউনিট বন্ধ ছিল, সেটিও শিগগির চালু হবে। দুটি ইউনিট সচল হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।”
ওজোপাডিকোর (ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান,
“আমরা গ্রিড থেকে যে পরিমাণ বরাদ্দ পাই, তা এখন অনেক কম। ফলে বাধ্য হয়ে এলাকা ভাগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে শহর ও গ্রামে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে।”
অন্যদিকে, বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির (রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র) উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আনোয়ারুল আজিম বলেন,
“আমাদের দুটি ইউনিটের প্রথমটি ফুল লোডে চলছে। দ্বিতীয়টি সাময়িকভাবে বন্ধ আছে, তবে দ্রুতই পুনরায় চালু হবে।”
খুলনার জনজীবন স্থবির: ভোগান্তির গল্প প্রতিটি ঘরে
ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় মারাত্মক প্রভাব
খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নাজিয়া সুলতানা জানান,
“অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও রিসার্চের কাজগুলো বিদ্যুৎ না থাকলে একদম থেমে যায়। গরমে ঘুমানো যায় না, মনোযোগ রাখা যায় না। মনে হয় পড়াশোনার গতি পুরোপুরি ভেঙে যাচ্ছে।”
রাতের অন্ধকারে ক্লান্ত মানুষের হাহাকার
নগরীর সাহেবের কবরখানা এলাকার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বলেন,
“সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে মানুষ রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। কিন্তু তখনই হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রিপেইড মিটার চালু থাকায় আমরা আগেভাগেই টাকা দিই, তারপরও এই হয়রানি — এটা অন্যায়।”
রূপসা উপজেলার বাগমারা এলাকার স্কুলশিক্ষিকা ফরিদা ইয়াসমিন পপি বলেন,
“তীব্র গরমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিতেও পারি না। ঘামে ভিজে ক্লান্ত শরীরে সংসারের কাজ সামলানোই এখন কষ্টকর। সন্তানদের পড়াশোনাও ব্যাহত হচ্ছে।”
আবহাওয়া ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে দ্বিগুণ কষ্ট
খুলনার শিববাড়ি এলাকার গৃহিণী রিতা মাকসুদা বলেন,
“দুই দিন আগেও বৃষ্টি হচ্ছিল, আজ আবার প্রচণ্ড রোদ। তার ওপর ঘন ঘন লোডশেডিং। ফ্ল্যাটের মধ্যে গরমে থাকা যায় না, ছাদে উঠেও বাতাস পাওয়া যায় না। এখনকার জীবন যেন পুরোপুরি বিদ্যুতের উপর নির্ভর।”
শিল্প ও ব্যবসায় খাতেও মারাত্মক প্রভাব
খুলনা শহর ও আশপাশের এলাকায় থাকা ছোট শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ফুলতলা শিল্পাঞ্চলের এক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন,
“আমরা ফ্রিজ, ওয়েল্ডিং ও মোটর মেশিনের কাজ করি। দিনে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অর্ডার সময়মতো দেওয়া যায় না। এতে লোকসান বাড়ছে।”
খুলনা জুট মিল ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের উদ্যোক্তারাও জানাচ্ছেন, ঠান্ডা রাখার যন্ত্র বারবার বন্ধ হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে রপ্তানি খাতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রামপাল ও আদানির ইউনিট বন্ধ: সমস্যার মূলে কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রামপাল ও আদানি — এই দুটি বড় উৎস থেকে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ আসে। সম্প্রতি কয়লার জাহাজ বিলম্বে পৌঁছানো, এবং ভারতীয় সীমান্তে সরবরাহ সমস্যার কারণে এই দুটি উৎসে আংশিক উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“রামপাল প্রকল্পটি কয়লাভিত্তিক, আর কয়লার জোগান সময়মতো না পেলে ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে আদানির বিদ্যুৎও সীমান্ত সংযোগের সমস্যায় পড়েছিল। তবে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।”
ওজোপাডিকোর বক্তব্য: “আমরাও অসহায়”
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ জাকিরুজ্জামান বলেন,
“লোডশেডিং সত্যিই আছে। আমরা গ্রিড থেকে যতটুকু পাই, তা এলাকাভাগ করে সরবরাহ দিই। চাহিদা বেশি, কিন্তু সরবরাহ কম। আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা, সঙ্গে কয়লার জটিলতা — সব মিলিয়ে এখন একটু অস্বস্তিকর সময় যাচ্ছে।”
স্মার্ট মিটারেও সমাধান আসেনি
বর্তমানে খুলনা শহরের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকায় প্রিপেইড মিটার চালু করা হয়েছে। অনেকের প্রত্যাশা ছিল, এতে বিল অনিয়ম ও অপচয় কমবে। কিন্তু লোডশেডিং বাড়ায় এখন নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
সোনাডাঙ্গার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন,
“আমরা টাকাটা আগে দিয়েই দিই। তারপরও যদি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলে যায়, তাহলে এর মানে কী? এটা জনগণের সঙ্গে অন্যায়।”
গরমের তাপমাত্রা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
খুলনা অঞ্চলে এই অক্টোবর মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। দিনে ৩৫ ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রায় বারবার বিদ্যুৎ না থাকলে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন ও ঘুমের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শারমিন হক বলেন,
“এভাবে ঘন ঘন লোডশেডিং হলে শরীরে পানিশূন্যতা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি ও অনিদ্রার সমস্যা বাড়ে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ।”
সরকারি উদ্যোগ ও আশার আলো
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট দ্রুত চালু করা হবে। কয়লা সরবরাহের সমস্যাও অনেকটাই কাটছে।
এছাড়া, ভবিষ্যতে সোলার পাওয়ার ও রিনিউয়েবল এনার্জি প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যাতে এ ধরনের সংকট দীর্ঘমেয়াদে আর না হয়।
পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন,
“রামপাল, পায়রা ও রূপপুরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চলছে। দক্ষিণাঞ্চলে বিকল্প শক্তির উৎস তৈরি হলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।”
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা: “আমরা শুধু স্বাভাবিক জীবন চাই”
খুলনা মহানগরীর মানুষ আজ শুধু একটাই দাবি জানাচ্ছেন — “যেন দিনরাত নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ থাকে।”
কারণ এই বিদ্যুৎ ঘাটতি শুধু আলো নিভিয়ে দেয় না, বরং থামিয়ে দেয় তাদের দৈনন্দিন জীবন, শিক্ষা, ব্যবসা ও স্বাস্থ্যসেবা।
MAH – 13337 I Signalbd.com