
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান এম এ মোমেন জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ পলাতক দুর্নীতিবাজদের দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে রিপোর্টার্স এগেইনস্ট করাপশন (র্যাক) আয়োজিত এক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই তথ্য জানান।
চেয়ারম্যান বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে চলছে, এবং দুদক কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য
ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পলাতক অভিযুক্তদের অবস্থান শনাক্ত ও গ্রেফতারের উদ্যোগ। দুদক চেয়ারম্যান জানান, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ বিদেশে আশ্রয় নেওয়া দুর্নীতির মামলার আসামিদের ফেরানোর অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
দুদক ইতিমধ্যে ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১২ জন উচ্চপর্যায়ের প্রাক্তন রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাটি এখন পর্যালোচনার অধীনে রয়েছে।
মোমেন বলেন, “আমরা চাই, যেসব ব্যক্তি রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পলাতক আছেন, তাদের বিচার হোক। এই প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
শেখ হাসিনার অবস্থান ও চলমান মামলা
জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ভারতের আশ্রয় নেন বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ একাধিক দুর্নীতির মামলার তদন্ত চলছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও দুদক—উভয় প্রতিষ্ঠানই তার বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, তার সরকারের সময়ে কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী বড় অঙ্কের আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিল, যার ফলে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রচেষ্টা চলছে। দুদক বলছে, “রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ আদায় ও দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করাই এখন প্রধান লক্ষ্য।”
দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে দুদকের কৌশল
দুদক চেয়ারম্যান জানান, বর্তমান কমিশন দুর্নীতি দমনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন,
“কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব আমাদের কাজে বাধা দিতে পারবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতিটি টাকার হিসাব নিশ্চিত না হয়।”
দুদক সম্প্রতি ৩৪টি নতুন অনুসন্ধান শুরু করেছে, যার মধ্যে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি জমি দখল, এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলাগুলো রয়েছে।
চেয়ারম্যান আরও আহ্বান জানান, রাজনৈতিক দলগুলো যেন আসন্ন নির্বাচনে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেয়। তার ভাষায়, “দুর্নীতিপরায়ণদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা না গেলে জাতি কখনও শুদ্ধ হবে না।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
দুদকের ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল বলছে, এই পদক্ষেপে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ দাবি করছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নেওয়া এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে শক্তিশালী করবে, তবে এটি বাস্তবায়ন করা জটিল হতে পারে। কারণ, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া পলাতক ব্যক্তিদের ফেরানো কঠিন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও প্রভাব
ইন্টারপোল সাধারণত সদস্য দেশের অনুরোধে রেড নোটিশ জারি করে থাকে, তবে এটি গ্রেফতারের নির্দেশ নয়। সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া আলাদা করে সম্পন্ন করতে হয়।
বাংলাদেশে আগেও বেশ কয়েকজন পলাতক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হলেও সেসব মামলার অনেকই এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনি সহযোগিতা মিলিত হয়, তবে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের ফিরিয়ে আনার পথ প্রশস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “রেড নোটিশ কার্যকর করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যদি ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে, তাহলে এটি একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ হবে।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্নীতিবাজদের সম্পদ ফিরিয়ে আনা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা বলেন, “এই অর্থ যদি বাজেটে ফেরত আসে, তাহলে তা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।”
দুদকের সর্বশেষ পদক্ষেপে শেখ হাসিনাসহ পলাতক দুর্নীতিবাজদের দেশে ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে এই উদ্যোগ কতটা সফল হয়।
রাজনৈতিক ও আইনি অঙ্গনে এ নিয়ে তীব্র আলোচনার মধ্যেই দেশবাসী অপেক্ষা করছে—রেড নোটিশের এই উদ্যোগ সত্যিই কি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারবে?
এম আর এম – ১৭৭০,Signalbd.com