
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট, যার উচ্চতা ৮,৮৪৯ মিটার, শুধু ভৌগোলিক বিস্ময় নয়—এটি এখন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির এক নীরব লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। এভারেস্টকে ঘিরে সম্প্রতি নামকরণ, ঐতিহ্য, আধিপত্য এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে চীন, নেপাল ও ভারতের মধ্যে পরোক্ষ প্রতিযোগিতা বেড়ে চলেছে। এই টানাপোড়েন শুধু একটি নাম বা একটি পাহাড় ঘিরেই নয়, বরং তা ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক ও কৌশলগত মানচিত্রে।
ব্রিটিশ ঐতিহ্য বনাম স্থানীয় সংস্কৃতি
বর্তমানে আমরা ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামে যাকে চিনি, সেটি একসময় ব্রিটিশরা ‘পিক নম্বর ১৫’ নামে চিহ্নিত করেছিল। ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার এন্ড্রু ওয়াহ তাঁর বস জর্জ এভারেস্টের নাম অনুসারে এই শৃঙ্গের নামকরণ করেন। অথচ এভারেস্ট কখনোই এখানে পা রাখেননি।
এই নামকরণ ছিল ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি নিঃশব্দ কৌশল। যদিও নেপাল কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়নি, তথাপি তাদের ভূখণ্ডে এমন একটি আন্তর্জাতিক নাম বসিয়ে দেওয়া পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বেরই প্রতিফলন। বর্তমানে নেপাল সরকার দাবি করছে, এভারেস্টের প্রকৃত ও স্থানীয় নাম ‘সাগরমাথা’ এবং সেটিই তারা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়।
চীনের দাবি: চোমোলাংমা
এভারেস্টের উত্তর পাশে অবস্থিত তিব্বতে এই পর্বতের নাম বহু আগে থেকেই ছিল ‘চোমোলাংমা’—অর্থাৎ “বিশ্বের মা দেবী”। চীন সরকার এখন তীব্রভাবে এই নামকে বৈশ্বিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এমনকি তাদের পুরোনো মানচিত্র ও ঐতিহাসিক চিত্রকর্মের মাধ্যমে তারা দাবি করছে যে, এভারেস্ট নামটি পশ্চিমা ‘হেজিমনি’র প্রতীক—তাই এটি বাতিল হওয়া উচিত।
তিব্বত বর্তমানে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হলেও, সাংস্কৃতিকভাবে এটি এক ঐতিহ্যবাহী সমাজ। চীন চাইছে তিব্বতের নামিক ইতিহাসকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে নিজেদের সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রমাণ করতে।
নেপালের অবস্থান: জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি সরাসরি বলেছেন, “এভারেস্ট নামটি মিথ্যা। এটি আমাদের পর্বত, আর তার নাম হবে ‘সাগরমাথা’, এর আর কোনো নাম হতে পারে না।” এ বক্তব্যের পেছনে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে। এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের দাবি নয়, বরং নেপালের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয় পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা।
১৯৩৮ সালে নেপালি ইতিহাসবিদ বাবুরাম আচার্য সর্বপ্রথম ‘সাগরমাথা’ নামটি ব্যবহার করেন, যার মানে ‘আকাশের শীর্ষ’। বর্তমানে নেপাল সরকার সেখান থেকেই প্রেরণা নিয়ে এ নামটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
ভারতের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
যদিও এভারেস্ট সরাসরি ভারতের সীমান্তের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবু ভারত এই বিতর্কে নিঃসঙ্গ নয়। ব্রিটিশ ভারতের সময়কালে বাঙালি গণিতজ্ঞ রাধানাথ শিকদারই প্রথম ত্রিকোণমিতির মাধ্যমে এভারেস্টের উচ্চতা গণনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবদান আজও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
ভারত এই বিতর্ককে চীন-নেপালের এক যৌথ সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে দেখছে। পাশাপাশি ভারতীয় মিডিয়াগুলো বলছে, যদি সাগরমাথা শব্দটি ১৯৩৮ সালের আগে না থেকে থাকে, তবে তার আগের নামগুলোর স্বীকৃতি কোথায়?
অর্থনৈতিক দিক: ট্যুরিজম ও রাজস্ব
এভারেস্ট এখন আর কেবল একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, বরং এটি বহু মিলিয়ন ডলারের এক ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্বতারোহী ও পর্যটক এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন নিয়ে আসেন। শুধুমাত্র ট্রেকিং পারমিট থেকেই নেপাল সরকার বছরে কোটি কোটি রুপি আয় করে।
চীন এখন তিব্বতের অংশ দিয়ে এভারেস্টকে আরো সহজলভ্য করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চালাচ্ছে—নতুন রাস্তাঘাট, রিসোর্ট, হেলিপ্যাড তৈরি করছে। এতে করে এভারেস্টের উত্তর দিক দিয়ে আরোহীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে নেপালের একচেটিয়া আয় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা
সামনে এভারেস্ট শুধু একটি নামকরণ বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতার প্রতীক। ভারত, চীন ও নেপালের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ, ঐতিহ্যগত নামকরণ ও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুই একেকটি মেরুকরণের অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
পরিবেশগত ঝুঁকি: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
এই গোটা বিতর্কে যেটি প্রায় অনালোচিত থাকছে তা হলো, পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভারেস্ট অঞ্চলে বরফ গলছে দ্রুত গতিতে। এর ফলে হিমালয়ের উৎসভূমি থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর উপর প্রভাব পড়বে—যা বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে প্রভাবিত করবে। প্রচুর পর্যটক, প্লাস্টিক বর্জ্য, অক্সিজেন সিলিন্ডার ফেলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সারসংক্ষেপ
মাউন্ট এভারেস্ট এখন আর শুধুই একটি পর্বত নয়। এটি একযোগে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত প্রতীক হয়ে উঠেছে। এর নাম কী হবে, কে এর মালিক, কোন পথে মানুষ উঠবে—এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু ইতিহাসের মধ্যে নেই, বরং বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তিত ভূরাজনীতির দিকনির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এই শৃঙ্গের নাম ও পরিচয়ের নতুন অধ্যায় শুরু হবে, কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, এভারেস্ট ঘিরে প্রতিযোগিতা এখানেই শেষ নয়।
এম আর এম – ০৩০১, Signalbd.com