
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত এলাকায় আবারও বড় ধরনের চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ অভিযানে প্রায় ৩ কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি ভর্তি একটি পিকআপ ভ্যান জব্দ করেছে সুলতানপুর ব্যাটালিয়ন (৬০ বিজিবি)।
বিজিবির পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান
বিজিবির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের একটি বিশেষ টহল দল সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকালে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল সীমান্ত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযান চলাকালে বিজিবি সদস্যরা একটি পিকআপ ভ্যানকে থামানোর সংকেত দিলে চালক দ্রুত গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তবে বিজিবির টহলদল ধাওয়া করে পিকআপটি আটক করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে গাড়িটি তল্লাশি করে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ ভারতীয় উন্নতমানের শাড়ি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩ কোটি টাকা।
চোরাচালানের বিরুদ্ধে বিজিবির ধারাবাহিক অভিযান
সুলতানপুর ব্যাটালিয়ন (৬০ বিজিবি)-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. জিয়াউর রহমান জানান, সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবির কার্যক্রম প্রতিনিয়ত জোরদার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন—
“আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলে অবৈধ পণ্য চোরাচালান এবং মাদক পাচার সম্পূর্ণরূপে দমন করা। বিজিবির প্রতিটি ব্যাটালিয়ন বর্তমানে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। এর অংশ হিসেবেই আজকের এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, জব্দ করা শাড়িগুলো কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট আইনানুগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পরে রাজস্ব বোর্ডে হস্তান্তর করা হবে।
স্থানীয়দের বক্তব্য: ‘প্রায়ই দেখা যায় এই পথে চোরাচালান হয়’
শশীদল সীমান্ত এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায়ই ভারতীয় পণ্য চোরাচালান হয়ে আসে।
স্থানীয় দোকানদার মিজান মিয়া বলেন,
“রাতের দিকে বা ভোরবেলায় অচেনা গাড়ি এদিক দিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে শুনি এসব গাড়িতে ভারতীয় কাপড় বা শাড়ি থাকে। বিজিবি এখন নিয়মিত টহল দিচ্ছে, এতে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।”
আরেকজন স্থানীয় নারী নূরজাহান বেগম বলেন,
“এই এলাকায় আগে প্রায়ই ভারতীয় কাপড় বিক্রি হতো। এখন বিজিবির কড়া নজরদারিতে তা অনেকটা কমে গেছে। আমরা চাই এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হোক।”
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চোরাচালানের প্রবণতা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় পণ্য চোরাচালানের প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। শাড়ি, প্রসাধনী, চা, সুপারি, ওষুধসহ নানা ধরনের পণ্য অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় চোরাচালানকারীরা লাভের আশায় ঝুঁকি নেয়। আবার সীমান্তের অনেক অংশ দুর্গম ও খোলা থাকায় অপরাধীরা সুযোগ নেয় সহজে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজিবির কড়া নজরদারি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে চোরাচালানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে বিজিবির আধুনিক উদ্যোগ
বিজিবি এখন সীমান্ত এলাকায় ড্রোন নজরদারি, থার্মাল ক্যামেরা, আধুনিক টহলযান ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।
বিজিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,
“বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় প্রতিদিন একাধিক মোবাইল টহল ও গোয়েন্দা অভিযান পরিচালিত হয়। স্থানীয় সূত্রগুলো থেকেও আমরা নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করি।”
তিনি আরও বলেন,
“চোরাচালানকারীরা এখন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে—মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ, গোপন রুট ব্যবহার, এমনকি কৃষিজমির মধ্য দিয়ে মালামাল পাচারের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিজিবি এসব কার্যক্রম প্রতিনিয়ত শনাক্ত করে দমন করছে।”
চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা
সুলতানপুর ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা যায়, আটক পিকআপটি ও উদ্ধারকৃত ভারতীয় শাড়িগুলো আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণপাড়া থানায় হস্তান্তর করা হবে।
চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তে বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে।
বিজিবি কর্মকর্তা জানান,
“আমরা বিশ্বাস করি, এই ঘটনার সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্র জড়িত। তদন্তে প্রকৃত মাস্টারমাইন্ডদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
দেশীয় শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভারতীয় শাড়ি অবৈধভাবে প্রবেশ করে। এর ফলে দেশীয় তাঁতশিল্প ও স্থানীয় বস্ত্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান,
“চোরাচালান হওয়া ভারতীয় পণ্যের কারণে স্থানীয় তাঁতিদের বিক্রি কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশে তৈরি শাড়ি ও কাপড়ের মানও এখন অনেক উন্নত, কিন্তু সস্তা চোরাচালান পণ্যের কারণে দেশীয় শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চোরাচালান বন্ধ করতে হলে শুধু বিজিবির অভিযান নয়, জনসচেতনতা, সীমান্তবর্তী জনগণের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং দৃঢ় আইনি ব্যবস্থা একসাথে নিশ্চিত করতে হবে।
বিজিবির সফলতা পরিসংখ্যানে
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুলতানপুর ব্যাটালিয়ন একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। ওই সময়ের মধ্যে ব্যাটালিয়নটি প্রায় ৪৫ কোটি টাকার চোরাচালানকৃত পণ্য জব্দ করে। এর মধ্যে ভারতীয় শাড়ি, গয়না, মদ, তামাকজাত দ্রব্য, ওষুধ ও মাদকদ্রব্যও ছিল।
বিজিবির সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে মোট ১,২০০টির বেশি চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়, যেখানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পণ্য উদ্ধার হয়।
সীমান্তে বিজিবির সতর্ক নজর
বর্তমানে বিজিবি শুধু চোরাচালান নয়, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানবপাচার ও মাদক পাচার প্রতিরোধেও কাজ করছে।
বিজিবি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চি জমি সুরক্ষিত রাখতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের সাম্প্রতিক অভিযান বিজিবির ধারাবাহিক সাফল্যেরই আরেকটি দৃষ্টান্ত। চোরাচালান প্রতিরোধে তাদের এই তৎপরতা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং দেশের অর্থনীতি সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ মানুষ একসঙ্গে সচেতন হলে সীমান্তে অবৈধ বাণিজ্য পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
MAH – 13309 I Signalbd.com