
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি স্কুল ও কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সরকার বিভিন্ন সময়ে তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চলতি বছর অক্টোবরের ৫ তারিখে বাড়িভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা শিক্ষকরা ‘তামাশা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই দিন ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস, যা পরিস্থিতিকে আরও ব্যঙ্গাত্মক করে তুলেছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল অভিযোগ
জাতীয় শিক্ষক ফোরামের নেতারা বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে। মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির দাবি থাকলেও সরকার বাস্তবে তা মেনে চলেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষকেরা এই পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
বেতন কাঠামো ও বৈষম্য
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মূল বেতন প্রায় ১২,৫০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া ১,০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা এবং বিশেষ প্রণোদনা অন্তত ১,০০০ টাকা যুক্ত হয়। এর পরেও ১০ শতাংশ কল্যাণ ও অবসর তহবিল কেটে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে একজন সহকারী শিক্ষকের মাসিক বেতন দাঁড়ায় ১৩,৭৫০ টাকা।
কলেজের ক্ষেত্রে মূল বেতন ২২,০০০ টাকা, বাড়িভাড়া ১,০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ এবং বিশেষ প্রণোদনা অন্তত ১,০০০ টাকা। ১০ শতাংশ কেটে নেওয়ার পর প্রভাষকের মোট বেতন প্রায় ২২,৩০০ টাকা।
ঢাকা বা শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকার খরচ কম নয়, তবু সকল শিক্ষকের বেতন সমান। এই অসামঞ্জস্য শিক্ষকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
বাড়িভাড়া ও বোনাস ইস্যু
সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে সাধারণত বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ হয়, অবস্থাগত কারণে তা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কোনো শতাংশ নির্ধারণ নেই; সর্বশেষ বাড়িভাড়া কেবল ৫০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বোনাসের ক্ষেত্রে সাধারণ চাকরিজীবী দুই ঈদে মূল বেতনের সমান বোনাস পান। কিন্তু শিক্ষকরা অতীতেও মূল বেতনের ২৫ শতাংশ পেতেন, এবং গত রোজার ঈদ থেকে ৫০ শতাংশ বোনাস প্রদান শুরু হয়েছে। এটি শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যমূলক ও অপ্রতুল বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্দোলন ও প্রতিবাদ
২০২৩ সালের জুলাইয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ২১ দিনের টানা অবস্থান কর্মসূচি চালানো হয়। পরে অনশন ভাঙার পরও সরকার তাদের দাবি পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
গত ১৩ আগস্ট এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা আবারও বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও শতভাগ উৎসব ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে পদযাত্রা ও মহাসমাবেশ করেছেন। শিক্ষক প্রতিনিধিদল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িভাড়া কেবল ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
পোশাক খাতের তুলনায় শিক্ষকদের বেতন
তৈরি পোশাক খাতে সর্বশেষ ন্যূনতম বেতন ১২,৫০০ টাকা (সহকারী কর্মীদের জন্য) এবং মাসিক বেতন অন্তত ১৫,০০০ টাকা। অতিরিক্ত ডিউটি করলে তা ২০,০০০ পর্যন্ত পৌঁছায়। যেখানে শিক্ষকেরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস, সেই তুলনায় পোশাকখাতে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। এতে শিক্ষক সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও প্রহসনের অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষণ
শিক্ষকদের দাবি যে মূল বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির, তা দীর্ঘদিন ধরা হলেও সরকার উদ্যোগী হয়নি। শিক্ষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা আর কতকাল চলবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা ন্যায্যভাবে বেতন, ভাতা ও কর্মপরিবেশ পাওয়ার দাবিতে একাধিক আন্দোলন চালাচ্ছেন।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং সাম্প্রতিক ‘৫০০ টাকা বাড়িভাড়া’ সিদ্ধান্ত শিক্ষকমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। শিক্ষকরা এখনও সরকারি পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছেন। শিক্ষকদের দাবিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই ‘তামাশা’ চলতেই থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এম আর এম – ১৭২৭,Signalbd.com