
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৫ জন চাকরিরত কর্মকর্তা বর্তমানে সেনা হেফাজতে রয়েছেন বলে জানিয়েছে সেনা সদর। তবে একজন কর্মকর্তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বাহিনী।
সেনা সদর: ১৫ কর্মকর্তা হেফাজতে, একজনের খোঁজ মিলছে না
শনিবার বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মোট ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন চাকরিতে আছেন। এদের আমরা সেনা হেফাজতে নিয়েছি। একজন কর্মকর্তা এলপিআরে (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) আছেন, আর একজনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি প্রতিষ্ঠান। তাই ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে তারা প্রস্তুত। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পরিবার থেকে কেউ যোগাযোগ করতে পারছেন না, কারণ তারা বর্তমানে অফিসিয়াল হেফাজতে রয়েছেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: মানবতাবিরোধী অপরাধ
গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বিরোধী মতের নাগরিকদের বেআইনি আটক, নির্যাতন এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই কর্মকর্তারা।
মামলাগুলো দুইটি পৃথক ঘটনার ভিত্তিতে দায়ের করা হয়েছে—একটি টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল এবং অন্যটি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)-এ আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে।
এই দুই মামলায়ই প্রধান আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর নাম রয়েছে। এছাড়া ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালকসহ আরও কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার নামও তালিকাভুক্ত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া: আইনের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল
সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, “আমরা এখনও ট্রাইব্যুনাল থেকে আনুষ্ঠানিক পরোয়ানা হাতে পাইনি, তবে সেনাবাহিনী সবসময় রাষ্ট্রের আইনকে সম্মান করে। তাই ৮ অক্টোবর থেকেই অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে সেনা সদরে সংযুক্ত আছেন। তারা ৯ অক্টোবর থেকে সেখানে অবস্থান করছেন। আপাতত তাদের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এটি একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।”
প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরও বলেন, “যদি কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন, তাহলে সেটি সেনা শৃঙ্খলা আইনে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নিখোঁজ সেনা কর্মকর্তা নিয়ে রহস্য
হাকিমুজ্জামান জানান, অভিযুক্ত ১৫ জনের মধ্যে একজন কর্মকর্তা সেনা হেফাজতের নির্দেশ অমান্য করেছেন এবং বর্তমানে নিখোঁজ আছেন। ওই কর্মকর্তার পরিচয় প্রকাশ না করলেও তিনি বলেন, “তার সন্ধান চলছে। আমরা ইতোমধ্যে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, যেন তিনি বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন।”
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আরও জানান, নিখোঁজ কর্মকর্তার পরিবারকে খোঁজখবর নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে তার অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
অভিযুক্তদের আদালতে হস্তান্তর প্রসঙ্গে সেনা সদর
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জানতে চান, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হবে কি না। এর জবাবে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, “আমরা আইনগত পরামর্শের অপেক্ষায় আছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে নির্দেশ দেবে, আমরা সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব। বর্তমানে সেনা সদর ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে অভিযুক্তদের হাজির করার নির্দেশ এসেছে। এর আগেই আমরা ট্রাইব্যুনাল থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার আশায় আছি।”
দীর্ঘদিনের অভিযোগ ও বিতর্ক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার একটি সংবেদনশীল বিষয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিচার প্রক্রিয়া নতুন করে আলোচনায় এসেছে, বিশেষ করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো সামনে আসার পর।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাধারণত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধ নিয়ে কাজ করে, তবে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। অনেকেই বলছেন, এই মামলাগুলোর মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
সেনা বাহিনীর ভাবমূর্তি ও প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনাটি সেনা বাহিনীর ভাবমূর্তিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সেনাবাহিনী সবসময় পেশাদারিত্ব ও আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো সংবেদনশীল অভিযোগ বাহিনীর জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনা সদর স্বচ্ছতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এই তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার ফলাফল বাহিনীর ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আইন ও ন্যায়বিচারের পরীক্ষার মুখে সেনা বাহিনী
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজতে নেওয়া এবং একজনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সেনাবাহিনী বলেছে, তারা আইনের শাসনে বিশ্বাসী এবং ট্রাইব্যুনালকে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া কেবল অভিযুক্তদের নয়, বরং পুরো বাহিনীর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার পরীক্ষাও হয়ে দাঁড়াবে। এখন দেখার বিষয়, আদালতের পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী এই মামলার ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়ায়।
এম আর এম – ১৭১৭,Signalbd.com