
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার গবেষণা ও সংস্কারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ আর নেই। বুধবার (৮ অক্টোবর ২০২৫) রাত ৯টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
ড. তোফায়েল আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনে গবেষণা, শিক্ষা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং সংস্কার কার্যক্রমে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের শোক
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন—
“অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার অন্যতম অগ্রদূত। তিনি নিষ্ঠা, সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে কাজ করেছেন। ২০২৪ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা আমাদের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। তাঁর গঠনমূলক ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাবনা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “তোফায়েল আহমেদ শুধু একজন গবেষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দিকনির্দেশক, ছিলেন আলোকবর্তিকা। তাঁর লেখা গ্রন্থ, গবেষণা ও প্রবন্ধ আমাদের আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন সৎ, প্রজ্ঞাবান ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষকে হারালাম।”
এক জীবন গবেষণায়, লেখালেখিতে এবং স্থানীয় সরকার সংস্কারে
ড. তোফায়েল আহমেদের কর্মজীবন মূলত শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও, তাঁর কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, সমবায় আন্দোলন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা—এসব বিষয় নিয়ে তিনি গভীরভাবে কাজ করেছেন।
বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২০টি। এর মধ্যে “বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার”, “প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা”, “লোকপ্রশাসনের রূপান্তর” প্রভৃতি গ্রন্থ গবেষক, শিক্ষার্থী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
দেশী-বিদেশি জার্নালে তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রবন্ধে তিনি শুধু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই করেননি, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনে ভূমিকা
২০২৪ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। সেখানে ড. তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করা হয়।
কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে কার্যকর পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেন। তাঁর প্রস্তাবনাগুলো ছিল স্বচ্ছ, কার্যকর এবং সময়োপযোগী। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালীকরণ, উপজেলা পরিষদের ভূমিকা বৃদ্ধি, নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
তাঁর নেতৃত্বে তৈরি সুপারিশসমূহ এখনও নীতি-নির্ধারক মহলে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে অবদান
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ অফিসে স্থানীয় শাসন উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার সংস্কারে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল।
এছাড়াও তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানীয় শাসনব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে তাঁর গবেষণা ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করেছে।
শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের দীর্ঘদিনের শিক্ষক ছিলেন ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, বরং শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। কঠোর কিন্তু ন্যায়পরায়ণ শিক্ষণপদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন।
অনেক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, “স্যার আমাদের শুধু প্রশাসন পড়াননি, শিখিয়েছেন কিভাবে একজন মানুষ হতে হয়।”
ব্যক্তিজীবন ও মূল্যবোধ
তোফায়েল আহমেদ ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনের মানুষ। সততা, দৃঢ়তা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর মূল বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি ছিলেন নির্দলীয় এবং কেবল গবেষণাকে প্রাধান্য দিতেন।
দেশের জন্য নিবেদিত এই মানুষটি কোনো পদ বা ক্ষমতার জন্য কখনও আগ্রহ দেখাননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল—বাংলাদেশে এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা হবে জনগণের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক।
জাতীয় শোক
ড. তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুতে শিক্ষা, গবেষণা, রাজনীতি ও প্রশাসনিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর সহকর্মী, শিক্ষার্থী, গবেষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং শুভানুধ্যায়ীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “তোফায়েল স্যার ছিলেন আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার গবেষণার প্রাণপুরুষ। তাঁর লেখা ও চিন্তা আমাদের পথ দেখাবে বহুদিন।”
পরিবার ও উত্তরাধিকার
ড. তোফায়েল আহমেদ স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে ও অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। পরিবার জানিয়েছে, তাঁর ইচ্ছানুসারে জানাজা শেষে জন্মস্থান কুমিল্লার গ্রামে তাঁকে দাফন করা হবে।
তাঁর রেখে যাওয়া গ্রন্থ, গবেষণা, প্রবন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদের মৃত্যু শুধু একজন গবেষকের মৃত্যু নয়, এটি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার আন্দোলনের এক বিশাল ক্ষতি। তিনি ছিলেন সততার প্রতীক, জ্ঞানের আলো ছড়ানো একজন পথিকৃৎ।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা যখনই হবে, তখনই তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে।
MAH – 13238 I Signalbd.com