
একসময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছিল ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আশার প্রতীক। বিভিন্ন দেশে সহজে ভিসা পাওয়া যেত, এমনকি অনেক দেশেই ভিসা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। আজকের বাস্তবতায়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে নিলেই অনেক দেশ ভিসা দেওয়ার আগে হাজারো প্রশ্ন তোলে। শুধু তাই নয়, যেসব দেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা আছে, সেখান থেকেও বাংলাদেশি যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিমানবন্দর থেকে।
ভিসা সংকটের বাস্তব চিত্র
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ভিসা পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। আগে যেখানে আবেদন জমা দিলেই সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ভিসা মিলত, এখন তা পেতে সময় লাগছে এক মাসেরও বেশি। তাছাড়া, ভিসা প্রত্যাখ্যানের হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
শুধু তাই নয়, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটননির্ভর দেশগুলোও বাংলাদেশিদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা না দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অথচ এসব দেশে কেবল হোটেল বুকিং ও ফিরতি টিকিট দেখালেই অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার কথা।
ভারতসহ প্রতিবেশী দেশের অবস্থান
২০২৪ সালের আগস্টে ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশিদের ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে সীমিত আকারে শুধু মেডিকেল ভিসা দেওয়া হচ্ছে, তাও দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে। নথিপত্রে সামান্য ভুল থাকলেই অফলোডের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
অন্যদিকে কাতার, বাহরাইন, মিশর, দুবাই, আবুধাবি, ভিয়েতনাম ভিসা বন্ধ করেছে। তুরস্ক ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো ভিসা প্রক্রিয়াকে করেছে জটিল ও দীর্ঘ।
কেন বাড়ছে এই অনীহা?
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি বড় কারণ:
- ভিসার অপব্যবহার: অনেকেই পর্যটন ভিসা নিয়ে বিদেশে প্রবেশ করলেও দেশে ফেরেন না। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও লুকিয়ে থেকে অবৈধভাবে কাজ করেন।
- অবৈধ অভিবাসন চক্র: দালালেরা বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশ পাঠিয়ে অবৈধ কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হয়।
- ভুয়া নথিপত্র: হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে আর্থিক প্রমাণ— সবকিছুতেই অনিয়ম ধরা পড়ছে। অনেকেই ভুয়া বুকিং কপি নিয়ে যাচ্ছেন, যার কারণে বিমানবন্দরেই ধরা পড়ে যাচ্ছেন।
- ট্রানজিট ব্যবহার: মালয়েশিয়া বা নেপালকে অনেক বাংলাদেশি ইউরোপে অবৈধভাবে যাওয়ার রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন।
সাম্প্রতিক তথ্য
শুধু ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসেই শত শত বাংলাদেশি মালয়েশিয়া বিমানবন্দর থেকে ফেরত এসেছেন। অনেকে বৈধ হোটেল বুকিং না থাকায় আটকা পড়েছেন, আবার কারও সঙ্গে পর্যাপ্ত ভ্রমণ খরচ ছিল না।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ জানায়, বাংলাদেশিরা সন্দেহজনক কাগজপত্র নিয়ে আসেন এবং অনেক সময় সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। এ কারণে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
থাইল্যান্ডের দীর্ঘসূত্রিতা
থাইল্যান্ডে ভিসা পেতে এখন প্রায় ৪৫-৫০ দিন লেগে যাচ্ছে। আবেদনের জন্য জমা দিতে হচ্ছে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সলভেন্সি সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, অফিসের অনাপত্তিপত্রসহ ডজনখানেক কাগজ। এর মধ্যেও অনেকের আবেদন বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অভিজ্ঞতা
আগে যেখানে নেপাল বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে ট্যুরিস্ট ভিসা দিত, এখন সেখানে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হচ্ছে। নতুন পাসপোর্টধারীরা সহজেই সন্দেহের তালিকায় চলে যাচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার কলম্বো বিমানবন্দরে এমনকি অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীদেরও আটকে দীর্ঘক্ষণ প্রশ্ন করা হচ্ছে। কোথায় থাকবেন, কীভাবে ভ্রমণ করবেন— এসব তথ্য না দিতে পারলেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
মালদ্বীপের কঠোর শর্ত
মালদ্বীপে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক হোটেল বুকিং কপি দেখাতে হয়। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি ভুয়া বুকিং নিয়ে যান। এছাড়া কোথায় থাকবেন তা স্পষ্টভাবে না বলতে পারলে তাদের দেশেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন—
“দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা ও নথিপত্র জালিয়াতি আমাদের পাসপোর্টের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। অনেক দেশ মনে করছে, বাংলাদেশিরা গেলে তাদের দেশে অপরাধ বাড়তে পারে। তাই তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।”
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি রাফিউজ্জামান রাফি বলেন—
“বিদেশ ভ্রমণ কমে যাওয়ায় পর্যটন শিল্পে বড় ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা।”
পাসপোর্ট র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স-এর সর্বশেষ সূচক অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল বিশ্বের ৬৮তম স্থানে। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশকে তা নেমে এসেছে ৯৪তম স্থানে। একই অবস্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন ও আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া।
২০২৩ সালে অবস্থান আরও খারাপ ছিল— ১০১তম। এ থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের পাসপোর্ট ধীরে ধীরে সবচেয়ে দুর্বল পাসপোর্টের কাতারে চলে যাচ্ছে।
সমাধানের পথ কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—
- ভিসার অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারের কড়া পদক্ষেপ প্রয়োজন।
- বিদেশগামী যাত্রীদের সঠিক তথ্য যাচাই করে পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়া উচিত।
- দালালচক্র দমন না করলে সমস্যা আরও বাড়বে।
- কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবেশী ও পর্যটননির্ভর দেশগুলোকে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
- বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের সচেতন হতে হবে— সঠিক বুকিং, পর্যাপ্ত অর্থ এবং বৈধ ভ্রমণ পরিকল্পনা ছাড়া ভিসা আবেদন করা উচিত নয়।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট একসময় ভ্রমণকারীদের জন্য ছিল গর্বের। কিন্তু অবৈধ অভিবাসন, ভিসার অপব্যবহার এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে এর গুরুত্ব দিন দিন কমছে। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র ও জনগণকে একসঙ্গে উদ্যোগী হয়ে এই সংকট মোকাবিলা করার। না হলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশি পাসপোর্ট মানেই হবে ‘সন্দেহ’, আর ভিসার দরজা হবে আরও কঠিন।
MAH – 13216 I Signalbd.com