বাংলাদেশ

ড. ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর বিদায়ী সাক্ষাৎ

Advertisement

বাংলাদেশ–জাতিসংঘ সম্পর্কের নতুন দিগন্তের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইস প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছেন। মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫) রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এ সাক্ষাৎকারে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs), জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, মানবাধিকার এবং বাংলাদেশ–জাতিসংঘ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

প্রধান উপদেষ্টার উপ–প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কী কাজ করেন?

বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন – UNDP, UNICEF, UNHCR, WHO, FAO ইত্যাদি সংস্থার কার্যক্রম সমন্বয় করেন তিনি। সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা এবং নীতি–পর্যায়ের সহযোগিতা নিশ্চিত করাই তাঁর মূল দায়িত্ব।

গুইন লুইস ২০২২ সালে বাংলাদেশে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দায়িত্ব পালনের সময়ে তিনি বাংলাদেশকে কোভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার, জলবায়ু অভিযোজন, নারী ও শিশু সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকট ব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার অগ্রগতিতে সহায়তা করেছেন।

বিদায়ী সাক্ষাৎকারে আলোচিত বিষয়

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই সাক্ষাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়।

১. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs):
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে।

২. জলবায়ু পরিবর্তন:
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে গুইন লুইস আশ্বাস দেন। তিনি জলবায়ু অভিযোজন তহবিল এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

৩. রোহিঙ্গা সংকট:
সাক্ষাতে রোহিঙ্গা বিষয়টিও আলোচনায় আসে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। গুইন লুইস তাঁদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

৪. মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসন:
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। জাতিসংঘও এ বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করবে।

গুইন লুইসের ভূমিকার প্রশংসা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুইন লুইসের দায়িত্বকালীন অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “গুইন লুইস বাংলাদেশে জাতিসংঘের কার্যক্রমকে আরও সক্রিয় ও ফলপ্রসূ করেছেন। উন্নয়ন ও মানবিক সহযোগিতায় তাঁর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

অন্যদিকে, গুইন লুইসও বাংলাদেশের জনগণের আতিথেয়তা ও দৃঢ় মনোবলের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এখানকার মানুষ আশাবাদী ও পরিশ্রমী।”

বাংলাদেশ–জাতিসংঘ সম্পর্ক

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে যোগ দেয়। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

এরপর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অন্যতম বৃহৎ অবদানকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে জাতিসংঘ বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী।

টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ বর্তমানে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় শিক্ষা বিস্তার, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অস্থায়ী সরকার টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিশেষ করে তাঁর ক্ষুদ্রঋণ অভিজ্ঞতা ও সামাজিক ব্যবসার দর্শন বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এবং নদীভাঙন প্রায় প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে। জাতিসংঘ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজন, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং টেকসই কৃষি কার্যক্রমে সহায়তা দিচ্ছে।

গুইন লুইস বিদায়ী সাক্ষাতে প্রতিশ্রুতি দেন যে জাতিসংঘ ভবিষ্যতেও জলবায়ু ন্যায়বিচার (Climate Justice) প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরের ক্যাম্পে বসবাস করছে। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির এখন কক্সবাজারে অবস্থিত।

জাতিসংঘ শুরু থেকেই বাংলাদেশকে এই সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। বিদায়ী সাক্ষাতে এ বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

গুইন লুইসের পরবর্তী দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন নতুন জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী, যিনি আগামী মাসে বাংলাদেশে যোগ দেবেন। বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, নতুন সমন্বয়কারীও একইভাবে উন্নয়ন সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তায় কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইসের এ বিদায়ী সাক্ষাৎ শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না; বরং বাংলাদেশজাতিসংঘ সম্পর্কের একটি প্রতীকী মাইলফলক। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।

জাতিসংঘ যেমন বাংলাদেশের উন্নয়ন, মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিনের অংশীদার, তেমনি বাংলাদেশও বৈশ্বিক শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

MAH – 13215 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button