
সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮২ জন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৫ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, আক্রান্তের হার কিছুটা কমলেও মৃত্যুহার উদ্বেগজনকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির সর্বশেষ চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন মোট ৭৮২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের এলাকায় ২০৮ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভাগগুলোতে ৫৭৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এ সময় তিনজনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় দুজন এবং খুলনা বিভাগে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক আক্রান্তের বিস্তারিত
গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে সর্বাধিক ১৭৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৩ জন, ঢাকা বিভাগে ১৪৫ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১১৮ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৯০ জন, খুলনা বিভাগে ৫৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৪ জন, ময়মনসিংহে ৩৫ জন, রংপুরে ১১ জন এবং সিলেটে ৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়া ৭৪৫ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ৬৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ৪৮ হাজারের বেশি ইতোমধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন।
পূর্ববর্তী বছরের সঙ্গে তুলনা
২০২৪ সালে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। আর ২০২৩ সালে ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ — তখন আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং প্রাণ হারান ১ হাজার ৭০৫ জন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তুলনামূলকভাবে ২০২৫ সালে রোগীর সংখ্যা কম হলেও ডেঙ্গু মৌসুমের শেষভাগে হঠাৎ আক্রান্তের হার বাড়তে পারে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়টি সাধারণত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসে আরও জোরদার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, জনগণকে বাসাবাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা। প্রতিটি বাড়ি, ছাদ, ফুলের টব ও ড্রেনের জমে থাকা পানি অপসারণ করা জরুরি।”
বিশেষজ্ঞদের মত
মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ নয়, বরং সারাবছর চলমান একটি জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। তাই শুধু বর্ষাকালেই নয়, সারাবছর নিয়মিত এডিস মশা দমন কার্যক্রম চালাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, নাগরিক দায়িত্বও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু দমন একটি যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়।”
পরিস্থিতির সামগ্রিক বিশ্লেষণ
ডেঙ্গুর প্রকোপের অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা নগরায়ণ, আবর্জনা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জলাবদ্ধতাকে দায়ী করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যাওয়ায় এডিস মশার প্রজনন সময়ও বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজধানী ঢাকায় মশার ঘনত্ব কমাতে “সোর্স রিডাকশন” পদ্ধতি প্রয়োগ করা জরুরি — অর্থাৎ মশার জন্মস্থান ধ্বংস করা।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মৃত্যুহার এখনো উদ্বেগজনক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আক্রান্তের হার বাড়তে পারে, যদি জনসচেতনতা না বাড়ে।
সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণের নিজস্ব সতর্কতা ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এম আর এম – ১৬৪০,Signalbd.com