
যশোরের আদালত এক নির্মম ও শোকবিহ্বল হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত বিচারক জাকির হোসেন টিপু সোমবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে এক ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবু নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বীথি (৩২) এবং দুই কন্যাসন্তান সুমাইয়া (৯) ও সাফিয়া (২)।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বাবু যশোর সদরের জগন্নাথপুর বিশ্বাসপাড়ার মশিউর বিশ্বাসের ছেলে। রায় ঘোষণার সময় আদালতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডে আসামি বাবুর মৃত্যুদণ্ডের রায় যথার্থ হয়েছে।”
হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা
আদালত ও মামলার সূত্রে জানা যায়, ঘটনা ঘটেছিল ২০২২ সালের ১৫ জুলাই। জহিরুল ইসলাম বাবু তার স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে নিয়ে তার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। এর আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশেষ করে পারিবারিক, আর্থিক ও মানসিক চাপের কারণে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য তীব্র রূপ নেয়।
ফেরার পথে, অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামে বাবু হঠাৎই স্ত্রী সাবিনা ও দুই কন্যাসন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। এরপর তিনি লাশগুলো যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে চেঙ্গুটিয়া এলাকার একটি বাগানে ফেলে রাখেন। হত্যার পর বাবু নিজেই বসুন্দিয়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে গিয়ে ঘটনার তথ্য জানান। পরে তাকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়।
সদ্য প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাবু ওই সময় মাদকাসক্ত ছিলেন। পুলিশি তদন্তে এ তথ্যও নিশ্চিত হয় যে, বাবু হত্যার আগে স্ত্রী ও কন্যাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন।
পরিবার ও পারিবারিক ইতিহাস
সাবিনা ইয়াসমিন বীথির বাবা মুজিবর রহমান অভিযোগ করেছেন, তার মেয়ের সঙ্গে বাবুর বিয়ে হয়েছিল প্রায় ১১ বছর আগে। বিয়ের পর থেকেই দাম্পত্য জীবনে বিরূপতা ও কলহ চলছিল। বাবু মাঝে মধ্যে বীথিকে মারধর করতেন এবং তার ওপর অর্থনৈতিক চাপও থাকত। এক পর্যায়ে বাবু এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দেন বীথিকে, কিন্তু তার নির্যাতন থামেনি। হত্যার দিনও ঝগড়া ও মারধরের ঘটনা ঘটেছিল।
মুজিবর রহমান জানান, “আমার মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের প্রতি বাবুর অত্যাচার ছিল নিয়মিত। এক পর্যায়ে তিনজনকেই হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে দেখে আমরা পুরো গ্রাম ও থানার কাছে অভিযোগ করি।”
পুলিশের তদন্ত ও মামলা
বাবুর বিরুদ্ধে অভয়নগর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এরপর থানার এসআই গোলাম হোসেন ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। পুলিশি তদন্তে বাবুর মাদকাসক্তি, দাম্পত্য কলহ, এবং হত্যার প্রমাণ সবই উঠে আসে। মামলার নথি অনুযায়ী, বাবু হত্যার পরে পুলিশের কাছে গিয়ে সব তথ্য খুলে বলেন।
মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো হলো:
- বাবু হত্যা করার আগে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন।
- তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন এবং মানসিকভাবে স্থির ছিলেন না।
- হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত ছিল। তিনি লাশ বাগানে ফেলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
- ঘটনার পরে বাবু নিজেই পুলিশে গিয়ে স্বীকার করেন।
আদালতের রায় ও ফাঁসির আদেশ
সোমবার (৬ অক্টোবর) আদালত রায় ঘোষণা করে, জহিরুল ইসলাম বাবুকে সর্বোচ্চ ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু রায়ের বিষয়ে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড পুরোপুরি পরিকল্পিত ছিল। তিনটি প্রাণ নেয়ার ঘটনায় সমাজের ন্যায্য বিচার নিশ্চিত হয়েছে।”
বিচারক জাকির হোসেন টিপু বলেন, “এ ধরনের হিংস্র হত্যাকাণ্ড সমাজের জন্য ভয়াবহ উদাহরণ। আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।”
সমাজে প্রতিক্রিয়া
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশের পর সমাজে শোক ও ক্ষোভের ছড়াছড়ি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, “এটি শুধু একটি পারিবারিক কলহ নয়, এটি সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী। আমরা চাই বিচার যেন দ্রুত সম্পন্ন হয়।”
পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং মামলার সকল প্রক্রিয়া শৃঙ্খলিতভাবে সম্পন্ন করছে। বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তা ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রশাসন নজরদারি বাড়িয়েছে।
শিশু ও নারী হত্যার মাত্রা
বাংলাদেশে নারী ও শিশু হত্যা কেবল পারিবারিক কলহের ফল নয়, এটি সামাজিক নিরাপত্তারও বড় সংকেত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, মাদকাসক্তি এবং সামাজিক চাপ একত্রিত হলে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা শক্তিশালী করা অপরিহার্য।
যশোরের এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সকলকে সতর্ক করছে। পারিবারিক কলহ, মানসিক চাপ, ও মাদকাসক্তি একত্রে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আদালতের কঠোর রায় প্রমাণ করেছে, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু শেষ মন্তব্যে বলেন, “এই রায় সমাজে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। কেউ যে কোনো প্রকার দমনে জীবন বা শিশুদের জীবন নাশ করতে পারবে না।”
এ ঘটনায় আইন, পুলিশি তৎপরতা, ও সামাজিক সচেতনতার গুরুত্ব আবারও浮রেছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এমন হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
MAH – 13197 I Signalbd.com