আঞ্চলিক

লাগামহীন লুটপাটে নিঃশেষ হচ্ছে সাদাপাথর: সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মারাত্মক ক্ষতি

Advertisement

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর এখন দ্রুত নিঃশেষের পথে। গত কয়েক মাস ধরে লাগামহীন লুটপাটের কারণে এই প্রাকৃতিক সম্পদ বিপন্ন হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের মাধ্যমে ধলাই নদীর উৎসমুখে জমে থাকা বিশাল পরিমাণ পাথরগুলো চোরাচালানকারীদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে, যা এলাকাটির সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।

সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনা ও বর্তমান অবস্থা

সাদাপাথর নামক এই পর্যটন এলাকা ধলাই নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলের কারণে পাঁচ একর এলাকা জুড়ে বিপুল পরিমাণ সাদা পাথর জমা হয়, যা দীর্ঘদিন পর ন্যাচারাল পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন শত শত নৌকা দিয়ে রাত-দিন পাথরগুলো অবৈধভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী একটি চক্র দিন-রাত লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি পুলিশি অভিযান থাকলেও তারা থামাতে পারেনি। পাথর লুটের এই অবস্থা প্রশাসনের নজরদারির বাইরে চলে গিয়েছে, যার ফলে সাদাপাথর দ্রুত পাথরশূন্য হয়ে পড়েছে।

সাদাপাথরের গুরুত্ব ও ইতিহাস

সাদাপাথর প্রকৃতিতে বিরল এক সম্পদ। এটি শুধুমাত্র পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে নয়, স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জমা পাথরগুলো স্থাপত্য শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এর বাজার মূল্য প্রচুর। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে এই পাথরের চাহিদা বেড়ে চলেছে।

১৯৯০ সালের পর প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে এই অঞ্চলে এত বড় পরিমাণ পাথর জমা হয়েছিল। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ প্রাথমিক পর্যায়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিল, তবে দীর্ঘমেয়াদি নজরদারির অভাবে আজ সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

প্রভাব ও পরিণতি

লুটপাটের ফলে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। পর্যটক সংখ্যা কমে গেছে, যার কারণে স্থানীয় ব্যবসা ও হোটেলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় এই অঞ্চলের বাসিন্দারা আতঙ্কিত।

এছাড়া, সাদাপাথর অঞ্চলের নদী তীরের বালি ও মাটির অবাধ উত্তোলন প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়েছে, যা ভবিষ্যতে বন্যার ঝুঁকি ও ভূমিধসের মতো বিপদ ডেকে আনতে পারে।

প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ

কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান জানান, সাদাপাথর লুটপাটের খবর পেলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিশেষ টাস্কফোর্স অভিযান চালানো হয়। পুলিশ ও বিজিবি যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে, কিন্তু চক্রটির ক্ষমতা এতটাই প্রবল যে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।

সিলেট বিভাগের কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেছেন, “পর্যটন কেন্দ্র খুঁড়ে পাথর উত্তোলন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা অবৈধ উত্তোলন বন্ধে ব্যাপক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”

তবে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাদাপাথর অঞ্চলের মত প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা না করা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ছাড়া এই লুটপাট থামানো সম্ভব নয়।

অর্থনীতিবিদরা জানান, সাদাপাথরের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন সম্প্রসারণ স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। এজন্য অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানো জরুরি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আশা

বর্তমানে সরকার ও প্রশাসন সাদাপাথর এলাকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন করছে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এই এলাকাটির গুরুত্ব ফেরানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তবে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অবৈধ উত্তোলন বন্ধ করা এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। যদি সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে সাদাপাথর সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।

এম আর এম – ০৮১১, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button