
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও প্রশাসন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে উদ্বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকল্পটি রাশিয়ার সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হলেও ভারতীয় অংশগ্রহণ, গোপন নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সিন্ডিকেট চক্রের কর্মকাণ্ড কৌশলগত ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পে তথ্য ও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ভারতীয় প্রভাব বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ফলাফল ডেকে আনতে পারে।
রূপপুর প্রকল্পে ভারতীয় প্রভাব: কৌশলগত সুবিধা
২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল, নয়াদিল্লিতে ভারতের পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (এআরবি) এবং বাংলাদেশের পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরবি) চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে পারমাণবিক নিরাপত্তা, বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ, যৌথ প্রশিক্ষণ, তথ্য বিনিময় এবং গবেষণায় সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আড়ালে ভারত প্রকল্পের স্পর্শকাতর নকশা, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে।
রূপপুর প্রকল্পে ভারতের এই প্রবেশ প্রকল্পের প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণে ভারতকে সুবিধা দিচ্ছে। যৌথ কমিটি, বৈজ্ঞানিক সভা, কর্মশালা, সিম্পোজিয়াম এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভারত সরাসরি প্রকল্প পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করছে।
তিনটি মূল চুক্তির মধ্যে রয়েছে:
- এআরবি-বিএইআরবি টেকনিক্যাল ইনফরমেশন শেয়ারিং চুক্তি
- পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কিত সহযোগিতা চুক্তি
- পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণে তথ্য বিনিময় চুক্তি
এই চুক্তিগুলো ভারতকে বাংলাদেশের পারমাণবিক অবকাঠামোর প্রায় প্রতিটি স্তরে প্রভাবিত করার সুযোগ দিচ্ছে। তথ্য, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রক অভিজ্ঞতার বিনিময় ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত করছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যৌথ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রকল্পের ভেতরে ভারতের পারমাণবিক দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত প্রভাব বৃদ্ধি করছে, যা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এমডি নিয়োগে অনিয়ম ও আইনি লঙ্ঘন
২০২৫ সালের ২৭ মে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের স্মারক অনুযায়ী ড. জাহেদুল হাছানকে ৩০ মে অবসরে পাঠানো হয়। কিন্তু ২৮ মে তিনি বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যতীত।
সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এবং পরমাণু শক্তি কমিশন সার্ভিস বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী এই ধরনের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। প্রকল্প সূত্র বলছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই গোপনীয়তা বজায় রেখে ড. জাহেদুলকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
পরিকল্পিত পদক্ষেপ ও নীলনকশার ঘটনা
রূপপুর প্রকল্পে ড. জাহেদুলকে টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
- ৭ মে, নতুন প্রকল্প পরিচালকের জন্য আবেদন চাওয়া হয়।
- ৮ মে, জাহেদুলকে এমডি পদে নিয়োগের জন্য প্রথমবারের মতো বিজ্ঞপ্তি জারি হয়।
- ১৫ মে, প্রকৌশলী হাসিনুর রহমানকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
- ২৫ মে, ড. কবির হোসেনকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়।
- ২৭ মে, জাহেদুলের পিআরএল মঞ্জুর হয়।
- ২৮ মে, পিআরএল বাতিল না করেই জাহেদুল এমডি পদে বসানো হয়।
- ১ জুন, অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে আইনি নোটিস।
- ৩০ জুন, সচিবের চাপে কমিশনকে পিআরএল বাতিলের নির্দেশ।
- ৭ জুলাই, জাহেদুলের পিআরএল ভূতাপেক্ষভাবে স্থগিত।
এই ধারাবাহিকতা দেখায়, প্রশাসনিক নিয়ম ভেঙে এক ব্যক্তিকে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ
ড. জাহেদুল হাছানের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে:
- ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার
- বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সম্পর্ক
- প্রকল্প পরিচালনায় অনিয়ম ও ব্যর্থতা
- এমডি পদে নিয়োগে পক্ষপাতদুষ্ট কমিটি ও অনিয়ম
- রিঅ্যাক্টরে ফুয়েল লোড করার চেষ্টা, যা আন্তর্জাতিক পরামর্শের বিরুদ্ধে
কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, জাহেদুল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা ও অপারেশন হস্তান্তরের জন্য কাজ করছেন।
সিন্ডিকেটের মূল ক্রীড়নক: অলক চক্রবর্তী
ড. জাহেদুলের সঙ্গে মিলেমিশে রূপপুর প্রকল্পে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেছেন অলক চক্রবর্তী। সূত্র বলছে, তিনি ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের প্রবেশ ও তদারকির মূল সুবিধা তৈরি করেছেন।
- ২০২২ সালের ২২ আগস্ট ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের ডেপুটেশন অর্ডার জারি
- ২০২৪ সালের ২৭ মে আরও চারজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ
অলক চক্রবর্তীর ভারত ও বিদেশ সফরও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। ২০১২-২৪ সালের মধ্যে তিনি ৩২ বার বিদেশ সফর করেছেন, এর মধ্যে ভারতে এক বছরের স্থায়ী অবস্থানও অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি, খালাস এবং মেটাল স্ক্র্যাপ ব্যবসা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
অলক চক্রবর্তীকে অভিযুক্ত করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রশাসনিক দুর্বলতা ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিদেশি অংশগ্রহণ ও তথ্যের স্বচ্ছতার অভাব নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য ও প্রযুক্তি ভারতের হাতে অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূত হলে কৌশলগত, নিরাপত্তাগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
পরিচালনার স্বচ্ছতা, নিয়োগ প্রক্রিয়ার আইনগততা, তথ্য সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনই প্রয়োজন। না হলে বাংলাদেশের এই বৃহত্তম শক্তি প্রকল্প সম্ভাব্য ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধুমাত্র শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র নয়, এটি কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু। প্রশাসনিক অনিয়ম, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশি অংশগ্রহণ নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে এখনই কঠোর নজরদারি, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
MAH – 13148 I Signalbd.com