বাংলাদেশ

সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪১৭, আহত ৬৮২

Advertisement

ঢাকা, ৪ অক্টোবর ২০২৫ – রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ৪৪৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও ৬৮২ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে নারী ৬৩ জন এবং শিশু ৪৭ জন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা চরমভাবে অনুভূত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এই তথ্যগুলো দেশের ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও নিজস্ব তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে দুর্ঘটনার ধরন, সময়, স্থান, যানবাহনের ধরন ও সামাজিক প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট মৃত্যুর ৩৪.২৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৩.৮৫ শতাংশ। এছাড়া ১১২ জন পথচারী মারা গেছেন, যা মোট মৃত্যুর ২৬.৮৫ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহনের চালক ও সহকারী হিসেবে মারা গেছেন ৫৬ জন, অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ১৩.৪২ শতাংশ

এছাড়া, দেশে ১৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৯টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনায় নিহতদের যানবাহনভিত্তিক বিশ্লেষণ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৪৩ জন (৩৪.২৯%), বাসযাত্রী ৩৫ জন (৮.৩৯%), ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও ট্রাক্টরের আরোহী ২৩ জন (৫.৫১%), প্রাইভেটকারের যাত্রী ৮ জন (১.৯১%), থ্রি–হুইলার (ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা, অটোভ্যান) যাত্রী ৬৯ জন (১৬.৫৪%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন, ভটভটি, টমটম, মাহিন্দ্র) যাত্রী ১৬ জন (৩.৮৩%), এবং বাইসাইকেল ও রিকশা আরোহী ১১ জন (২.৬৩%) মারা গেছেন।

দুর্ঘটনার স্থান ও ধরন

সড়ক দুর্ঘটনার স্থানভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার ৩৬.০৯ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩১.১৬ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে, ১২.৭৮ শতাংশ গ্রামীণ সড়কে এবং ১৯.৯৫ শতাংশ শহরের সড়কে ঘটেছে।

ধরন অনুযায়ী দুর্ঘটনার বন্টন:

  • মুখোমুখি সংঘর্ষ: ২০.৬২%
  • নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা: ৩৮.৩৪%
  • পথচারীকে ধাক্কা বা চাপা দেওয়া: ২৬.৬৮%
  • পেছন থেকে আঘাত: ১৩%
  • অন্যান্য: ১.৩৪%

দুর্ঘটনায় ৬৬১টি যানবাহন জড়িত ছিল, যার মধ্যে ভারী যানবাহন যেমন ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, ট্রাক্টর ও লরি ২৫.৫৬%, বাস ১৮%, মোটরসাইকেল ২৪.০৫%, থ্রি–হুইলার ১৫.২৭%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৬.৬৫%, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও জিপ ৩.৯৩%, বাইসাইকেল ও রিকশা ২.৮৭%, এবং অজ্ঞাত যানবাহন ৩.৬৩%

সময়ভিত্তিক দুর্ঘটনা

সময়ের ওপর ভিত্তি করে দুর্ঘটনার হার বিশ্লেষণ করলে দেখা গেছে:

  • সকাল: ৩০%
  • দুপুর: ২০.৬২%
  • বিকেল: ১০.৭৬%
  • সন্ধ্যা: ৭.১৭%
  • রাত: ২৩.৫৪%
  • ভোর: ৭.৮৪%

এই তথ্য প্রমাণ করছে, সকাল ও রাতের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, যা পথচারী ও চালক উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ সময়।

বিভাগভিত্তিক দুর্ঘটনা

সর্বাধিক দুর্ঘটনা ঢাকা বিভাগে হয়েছে – ১২৮টি দুর্ঘটনায় ১২৪ জন নিহত। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪% দুর্ঘটনা, রাজশাহী বিভাগে ১৮.৮৩%, সিলেট ৮.২৯%, ময়মনসিংহ ৫.৩৮%, রংপুর ৪.৪৮%, খুলনা ৬.৭২%, এবং বরিশাল ৩.৫৮%।
একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে ৫২টি দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা মাগুরায় – ৮টি দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত। রাজধানী ঢাকায় সেপ্টেম্বর মাসে ৪২টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হয়েছেন।

নিহতদের পেশাগত প্রোফাইল

প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, নিহতদের মধ্যে:

  • পুলিশ সদস্য: ২ জন
  • শিক্ষক: ৭ জন
  • সাংবাদিক: ৩ জন
  • ব্যাংক ও বিমা খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারী: ৬ জন
  • এনজিও কর্মী: ৭ জন
  • রাজনৈতিক নেতা–কর্মী ও ইউপি সদস্য: ৬ জন
  • ব্যবসায়ী: ১৮ জন
  • বিক্রয় প্রতিনিধি: ৯ জন
  • মোটর মেকানিক: ২ জন
  • পোশাক শ্রমিক: ৪ জন
  • নির্মাণ শ্রমিক: ৩ জন
  • কৃষি শ্রমিক: ৩ জন
  • চা শ্রমিক: ১ জন
  • উদীচী কর্মী: ১ জন
  • শিক্ষার্থী: ৪৯ জন

এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন দুর্ঘটনার ১১টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে:

  1. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন
  2. খারাপ সড়ক অবকাঠামো
  3. বেপরোয়া গতি
  4. চালকের অদক্ষতা
  5. অশৃঙ্খল বেতন ও কর্মঘণ্টা
  6. মহাসড়কে স্বল্পগতির যান চলাচল
  7. তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো
  8. ট্রাফিক আইন অমান্য
  9. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা
  10. বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি
  11. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি

দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ

প্রতিবেদনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন উল্লেখ করেছে যে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা জরুরি:

  • দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু
  • চালকদের নির্দিষ্ট বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা
  • বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা উন্নয়ন
  • মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ ও রোড ডিভাইডার স্থাপন
  • গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা
  • রেল ও নৌপথের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন
  • টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন
  • ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করা

ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে, এসব পদক্ষেপ দ্রুত কার্যকর করা হলে সড়ক দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা শুধু মৃত্যুর কারণ নয়, এটি পরিবার ও সমাজের জন্যও দীর্ঘমেয়াদী সংকট সৃষ্টি করে। প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে, দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে মানবীয় ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি ট্রাফিক আইন অমান্য অন্যতম।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে, দেশের সড়কগুলো হবে আরও নিরাপদ, আর নিহত ও আহতদের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি চালক, পথচারী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, নিরাপদ ও সচেতন পরিবেশ নিশ্চিত করা।

MAH – 13144 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button