গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে একটি রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিনজন ফায়ার ফাইটারসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) সকালে এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন,
“অগ্নিকাণ্ডে জীবন রক্ষার মহৎ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের তিনজন সাহসী ফায়ার ফাইটারসহ চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। এটি এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমি নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন,
“ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দিনরাত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের এই আত্মত্যাগের কাছে জাতি চিরঋণী।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল ও পরিস্থিতি
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সিটির টঙ্গী এলাকার মিলগেট সংলগ্ন একটি রাসায়নিক গুদামে হঠাৎ করেই আগুন লাগে। গুদামে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন ফায়ার ফাইটার নিহত হন।
আরেকজন শ্রমিক, যিনি গুদামে কর্মরত ছিলেন, তিনি দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে কয়েকজন ফায়ার ফাইটার ও সাধারণ মানুষকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার ফাইটারদের আত্মত্যাগ
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডেই ফায়ার ফাইটারদের জীবনহানি ঘটে। তবুও তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে পিছপা হন না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং দাহ্য রাসায়নিকের অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ ফায়ার ফাইটারদের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিহত তিন ফায়ার ফাইটার ছিলেন অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তবে আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে মুহূর্তের মধ্যে তাদের জীবন কেড়ে নেয়।
প্রধান উপদেষ্টার বার্তা – জাতির প্রতি আহ্বান
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন,
“আজকের এই দুর্ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল যে দায়িত্ব পালনের সময় ফায়ার ফাইটাররা কত বড় ঝুঁকি বহন করেন। তাদের এ মহৎ ত্যাগ জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর উদ্দেশে বলেন,
“আপনাদের প্রিয়জনরা নিছক প্রাণ হারাননি, তারা জাতির জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষ তাদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আমি দোয়া করছি এই কঠিন সময়ে আল্লাহ যেন আপনাদের ধৈর্য ও শক্তি দেন।”
বাংলাদেশের অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে প্রায়ই শিল্প কারখানা ও গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে রাসায়নিক কারখানা, গুদাম এবং পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক গুদাম ও শিল্প এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে। গুদামগুলোতে সঠিকভাবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা হয় না, অনেক সময় ফায়ার সেফটি অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা পরিচালিত হয়।
জরুরি করণীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
১. রাসায়নিক গুদামের সঠিক লাইসেন্স ও মনিটরিং নিশ্চিত করা।
২. প্রতিটি শিল্প কারখানায় আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা স্থাপন করা।
৩. ফায়ার ফাইটারদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
৪. শ্রমিক ও মালিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৫. আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
জাতির কাছে প্রেরণা
অগ্নিকাণ্ডে নিহত ফায়ার ফাইটার ও শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগ আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়— আমরা কি যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি? তাদের জীবন উৎসর্গ যেন শুধুই শোকের খবর না হয়, বরং এটি যেন ভবিষ্যতে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
গাজীপুরে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কেবল চারটি প্রাণই কেড়ে নেয়নি, এটি আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কত বড় ঝুঁকির মধ্যে প্রতিদিন ফায়ার ফাইটাররা কাজ করেন। প্রধান উপদেষ্টার শোকবার্তা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এই সাহসী মানুষগুলো আমাদের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।
নিহতদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় থাকবে, তবে একইসঙ্গে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে যাতে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আর না ঘটে। নিরাপদ শিল্প ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
MAH – 13040 I Signalbd.com



