
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও এক সাহসী ফায়ারকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে গতকাল মঙ্গলবার ভোররাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্য নুরুল হুদা (৩৮)।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেল কর্মকর্তা তালহা বিন জসীম আজ বুধবার বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আগুন নেভাতে গিয়ে শতভাগ দগ্ধ হন নুরুল হুদা
সোমবার রাতে টঙ্গীর সাহারা মার্কেট এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে আগুনে আটকা পড়েন ফায়ারকর্মী নুরুল হুদা। তিনি শতভাগ দগ্ধ হন। দ্রুত তাঁকে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তাঁকে রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
নুরুল হুদার জীবনী ও আত্মত্যাগ
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বাসিন্দা নুরুল হুদা ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন। দীর্ঘ ১৮ বছরের কর্মজীবনে তিনি বহু দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সহকর্মীদের ভাষায় তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল, সাহসী ও মানবিক এক কর্মী। তাঁর বাবা আব্দুল মনসুর এবং মা শিরিনা খাতুন শোকের সাগরে ভাসছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফনের ঘোষণা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
একই ঘটনায় আগেই নিহত হন আরেক ফায়ারকর্মী
এর আগেই একই অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মঙ্গলবার দুপুরে মারা যান ফায়ার সার্ভিসের আরেক সদস্য শামিম আহমেদ (৪২)। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মাসকা ইউনিয়নের পিজাহাটি গ্রামে। দুই ফায়ারকর্মীর মৃত্যুতে শুধু ফায়ার সার্ভিস নয়, পুরো জাতি শোকাহত।
টঙ্গীর রাসায়নিক গুদামের আগুন: ভয়াবহ পরিস্থিতি
টঙ্গী শিল্পাঞ্চল ও আশপাশের এলাকায় বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের অবৈধ ও অনিরাপদ রাসায়নিক গুদাম। এগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সোমবারের অগ্নিকাণ্ডও ঘটেছিল এমন একটি গুদামে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসেন।
ফায়ার সার্ভিসের ১২টিরও বেশি ইউনিট কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে ভেতরে রাসায়নিক থাকায় বারবার বিস্ফোরণের মতো শব্দ হয়, ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ঝুঁকির মুখে পড়েন ফায়ারকর্মীরা।
রাসায়নিক গুদামের অনিরাপত্তা: পুরনো সমস্যা
বাংলাদেশে গুদাম ও কারখানায় অগ্নিকাণ্ড নতুন নয়। ২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৭১ জন। প্রতিবারই রাসায়নিক গুদাম সরানোর প্রতিশ্রুতি আসে, তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু বাস্তবে তেমন অগ্রগতি দেখা যায় না।
টঙ্গীর এই অগ্নিকাণ্ড আবারও প্রমাণ করল—অনিরাপদ গুদামগুলো রাজধানী ও শিল্পাঞ্চলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের দাবি: আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা দরকার
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, রাসায়নিক পদার্থের গুদাম বা কারখানা আবাসিক বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাখা বিপজ্জনক। এসব গুদাম অনুমোদিত শিল্পাঞ্চলে স্থানান্তর করা জরুরি। পাশাপাশি উদ্যোক্তা ও মালিকদের সচেতন হতে হবে।
সহকর্মীদের কণ্ঠে শোক ও ক্ষোভ
ফায়ার সার্ভিসের সহকর্মীরা জানান, প্রতিবারই আগুন নেভাতে গিয়ে ঝুঁকি নিতে হয় তাঁদের। কিন্তু যথাযথ নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, রাসায়নিকের ঝুঁকি সম্পর্কে মালিকদের অবহেলা এবং প্রশাসনের শিথিলতায় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের জীবন প্রায়ই বিপন্ন হয়।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা জানি, জীবন ঝুঁকি নিয়েই কাজ করি। কিন্তু দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে যদি প্রতিবারই আমাদের সহকর্মীদের হারাতে হয়, তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
দেশের মানুষের শোক ও ক্ষোভ
টঙ্গীর এই দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের ঢল নামে। সাধারণ মানুষ দুই ফায়ারকর্মীর সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এবং তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন। পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকে।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রত্যাশা
অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি নতুন নয়। কিন্তু সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় বারবার প্রাণহানি ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিক পদার্থের গুদামগুলো নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।
টঙ্গীর রাসায়নিক গুদামের এই অগ্নিকাণ্ড শুধু দুই ফায়ারকর্মীর প্রাণ কাড়েনি; এটি আবারও মনে করিয়ে দিল কতটা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি আমরা। নুরুল হুদা ও শামিম আহমেদ দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ যেন আরেকটি নিমতলী বা চকবাজার ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তোলে।
MAH – 12994 I Signalbd.com