বাংলাদেশ

টঙ্গীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ নিহত

Advertisement

গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন সাহসী ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকর্মীদের মাঝে। পাশাপাশি পুরো দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়—কেন বারবার কেমিক্যাল গুদামের মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তাহীনভাবে মানুষ কাজ করছে, কেন এত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।

কীভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা?

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) টঙ্গীর একটি নামহীন কেমিক্যাল গোডাউনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। দমকল বাহিনী খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করে।

তবে আগুনের তীব্রতা ছিল এতটাই ভয়ঙ্কর যে ফায়ার ফাইটারদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এই সময় দগ্ধ হন শামীম আহমেদসহ চারজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী। তাদের দ্রুত উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসকরা জানান, শামীম আহমেদের শরীরের শতভাগ পুড়ে গিয়েছিল। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

চিকিৎসকদের বক্তব্য

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান গণমাধ্যমকে জানান—
“আমাদের কাছে চারজন দগ্ধ অবস্থায় এসেছিলেন। তাদের মধ্যে শামীম আহমেদের শরীরের ১০০ শতাংশই দগ্ধ ছিল। উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হলেও তার শারীরিক অবস্থা আর সামলানো যায়নি। বিকেল ৩টার দিকে তিনি মারা যান।”

বর্তমানে আরও তিনজন দগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাদের মধ্যে দু’জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সাহসী ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদের জীবনী

শামীম আহমেদ ২০০৪ সালে ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন। দীর্ঘ দুই দশকের কর্মজীবনে অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডে অংশ নিয়ে বহু জীবন বাঁচিয়েছেন তিনি। সহকর্মীদের মতে, তিনি ছিলেন সাহসী, দায়িত্বশীল এবং সবসময় মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ।

তার বাড়ি নেত্রকোণা জেলায়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন তিনি। ফলে তার মৃত্যুতে পরিবার চরম আর্থিক ও মানসিক সংকটে পড়েছে।

জানাজা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরে মাগরিবের নামাজের পর শামীম আহমেদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অসংখ্য সাধারণ মানুষ।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য তালহা বিন জসিম জানান—
“শামীম আহমেদ আমাদের গর্ব। তিনি জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার আত্মত্যাগ কখনও ভোলা যাবে না।”

কেন বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে?

বাংলাদেশে কেমিক্যাল গুদামগুলোর নিরাপত্তাহীনতা নতুন কিছু নয়। রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায়ই গুদাম, কারখানা বা বাজারে অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে।

সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো—

  • ২০১০ সালে নিমতলীর কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২৪ জন নিহত হয়েছিলেন।
  • ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে কেমিক্যাল গুদামের অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে।
  • ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে ৫২ জন শ্রমিক মারা যান।

প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সুপারিশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ খুব কমই কার্যকর হয়। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘন ঘন ঘটে যাচ্ছে।

টঙ্গীর কেমিক্যাল গোডাউন: মালিক লাপাত্তা

এই ঘটনায় আলোচনায় এসেছে আরেকটি বিষয়—গুদামের মালিক কোথায়? তদন্তে জানা গেছে, কেমিক্যালগুলো অননুমোদিতভাবে ও নিরাপত্তাহীনভাবে রাখা হয়েছিল। তবে ঘটনার পর থেকেই মালিক পলাতক।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন বিপজ্জনক গুদাম বছরের পর বছর চললেও কেউ নজরদারি করেনি। এখন প্রাণহানি ঘটার পর দায় চাপানো হচ্ছে একে অপরের ওপর।

ফায়ার সার্ভিসের ঝুঁকি ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের ফায়ার ফাইটাররা প্রতিদিন জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী?

ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখনও পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম, আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ তাদের হাতে নেই। ফলে কেমিক্যাল বা গ্যাস বিস্ফোরণের মতো ঘটনায় ফায়ার ফাইটাররা সরাসরি প্রাণঘাতী ঝুঁকির মুখে পড়েন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফায়ার সার্ভিসকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি দিয়ে শক্তিশালী করা জরুরি। পাশাপাশি কেমিক্যাল গুদামগুলো শনাক্ত করে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

সরকারের প্রতিশ্রুতি

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই সরকার ঘোষণা দিয়েছে—দগ্ধদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদের পরিবারের জন্য আর্থিক অনুদান ও সরকারি সহায়তার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।

তবে নাগরিক সমাজের প্রশ্ন—প্রতিবারই কি শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি এবার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে?

জনমতের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যেই তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই লিখছেন—
“প্রতিবারই ফায়ার ফাইটাররা নিজের জীবন দিয়ে মানুষ বাঁচান। কিন্তু তাদের জন্য কী ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে?”

অন্যরা বলছেন—
“ঢাকায় কেমিক্যাল গুদামের অস্তিত্ব সবার জানা, তবুও এগুলো সরানো হয় না। সরকার ও প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে।”

ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন সত্যিকারের বীর, যিনি মানুষের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

এই ঘটনার পর একটাই প্রশ্ন সামনে আসছে—আর কত প্রাণ গেলে কেমিক্যাল গুদাম ও অগ্নিকাণ্ডকে গুরুত্বের সাথে দেখা হবে? শুধু শোক ও অনুদান নয়, কার্যকর পদক্ষেপই এখন জরুরি।

MAH – 12975 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button