বাংলাদেশ

মহান শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে না পারায় মানবতা কী হেরে গেল

Advertisement


উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় নিজের জীবন দিয়ে শিশুদের বাঁচানো সাহসী শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। এই অবহেলা কি আমাদের নৈতিকতা, বিবেক ও মানবতাবোধের পরাজয়ের প্রতীক হয়ে থাকবে?

এক সাহসী শিক্ষিকার নাম মাহরীন চৌধুরী

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। এ দুর্ঘটনায় যখন বিদ্যালয়ের একটি ভবন ভেঙে পড়ে এবং ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভয়াবহ আতঙ্কে সবাই যখন পালানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে আগুন থেকে বের করে আনেন।

তিনবার, চারবার নয় — একাধিকবার আগুনের মুখে ঢুকে শিশুদের বাঁচিয়ে আনার দৃঢ় মনোবল ও মানবিকতার নজির রেখেছেন তিনি। শেষবার যখন আগুনে ঢোকার পর আর বের হতে পারেননি, তখনই মাহরীন চৌধুরীর এই অসীম সাহসিকতার গাথা চিরস্মরণীয় হয়ে ওঠে। দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর কাছে হার মানলেও তিনি মানবতার সামনে জয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন: এক গভীর নৈতিক সংকট

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত প্রশিক্ষণার্থী পাইলটকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যিনি সরকারি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় একটি ভুলের শিকার হয়ে মারা গেলেন, তাকে যখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তখন কেন এক মহান শিক্ষিকাকে সেই মর্যাদা দেওয়া হলো না, যিনি নিজের ইচ্ছায়, দায়িত্ববোধে এবং মানবতার জন্য জীবন দিয়েছেন?

একজন অসামরিক নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু তার শেষকৃত্যে রাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি বা মর্যাদা না থাকায় জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে — রাষ্ট্র কি কেবল সরকারি পদের ভিত্তিতে সম্মান দেয়? মানবিক বীরত্ব কি কোনো বিবেচনায় আসে না?

শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন: একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রতি সম্মান বরাবরই কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকদের সেই স্বীকৃতি বরাবরই অবহেলিত।

অথচ উন্নত বিশ্বে শিক্ষকতাকে জাতি গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ — এসব দেশে স্কুল শিক্ষকদের সরকারি পুরস্কার, বৃত্তি ও সম্মানজনক মর্যাদা দেওয়া হয়। সেখানে প্রতিটি বছর শিক্ষকদের সাহসিকতা বা ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ প্রমাণ করেছে, একজন স্কুল শিক্ষকও দেশের গর্ব হতে পারেন। যদি জাতি হিসেবে আমরা সত্যিই শিক্ষা ও মানবিকতা মূল্যায়ন করতে চাই, তাহলে এমন আত্মত্যাগীদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া জরুরি।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জনমত: জনগণ কি সরকারের চেয়েও মানবিক?

মাহরীন চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক, শ্রদ্ধা ও ক্ষোভের ঝড় ওঠে। রাজনীতিক, বিশিষ্ট নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেই একমত হয়েছেন—এই নারী রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত হওয়ার দাবিদার।

“শিক্ষক নয়, তিনি এক মহান আত্মা”, “এই আত্মত্যাগ জাতিকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে”, “রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেওয়া মানে মানবতাকে অপমান করা” — এ ধরনের মন্তব্যে ভরে যায় সামাজিক প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু রাষ্ট্রের তরফ থেকে এখনও কোনো আশ্বাস বা পদক্ষেপ না আসায় মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।

দায়-দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের বার্তা: রাষ্ট্রের করণীয় কী?

এই দুর্ঘটনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে—প্রশিক্ষণ বিমান কেন জনবহুল এলাকায় উড়াল দিচ্ছিল? যদি কারিগরি ত্রুটি ছিল, তবে সেটিকে খালি বা নিরাপদ এলাকায় নামানোর বিকল্প কি ছিল না? শিশুদের প্রাণহানির ঘটনায় প্রশ্নের মুখে বিমান বাহিনীর দায়িত্বশীলতা, পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা।

যুদ্ধবিমান ব্যবহারের উপযোগিতা, পুরোনো প্রযুক্তির ঝুঁকি, এবং জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নের উত্তর না দিলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা আবার ঘটতে পারে — এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিরীহ নাগরিকেরা।

“রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি নৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন”

মানবাধিকার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয় — এটি একটি বার্তা, যা সমাজের মূল্যবোধ নির্ধারণ করে। মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ন্যূনতম স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে।

বিশ্লেষকদের মতে, “রাষ্ট্র যদি নিজের আত্মত্যাগী নাগরিকদের যথাযথ সম্মান না দেয়, তাহলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভুল বার্তা দেয়। তারা শিখে যায়, বীরত্বের মূল্য নেই, কেবল পদমর্যাদাই সবকিছু।”

মাহরীন চৌধুরী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পেলে ইতিহাস দায় নেবে

মাহরীন চৌধুরী শুধুমাত্র একজন শিক্ষক নন, তিনি মানবতার প্রতীক। তাঁর আত্মত্যাগ শুধু একটি বিদ্যালয়ের বা একটি পরিবারের নয়, তা গোটা জাতির কাছে অনন্য দৃষ্টান্ত। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দিলে তা আমাদের জাতীয় বিবেকের পরাজয়।

রাষ্ট্র এখনো সময় আছে — নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার। মাহরীন চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানালে তা হবে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, মানবতার স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্ত বার্তা। নইলে আমাদের আগামী প্রজন্ম জানবে, এই দেশ আত্মত্যাগীদের সম্মান দিতে জানে না।

এম আর এম – ০৪৯০  , Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button