বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত চুক্তি উন্মুক্ত করার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও চুক্তি সংক্রান্ত তথ্য আরও স্বচ্ছভাবে জনসমক্ষে প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন ২০২৫’-এ বাংলাদেশের প্রতি আটটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত চুক্তি ও সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার আইনি কাঠামোর মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও লাইসেন্স প্রদানের নিয়মনীতি নির্ধারণ করলেও এসব তথ্য জনগণের কাছে যথাযথভাবে উন্মুক্ত করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশ না করলে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা অর্জন কঠিন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের মূল সুপারিশ
স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা জোরদার করতে যে আটটি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো—
- প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের চুক্তি ও লাইসেন্স প্রদানের তথ্য প্রকাশ করা।
- সরকারি ক্রয়চুক্তি সম্পর্কিত সব তথ্য জনসমক্ষে আনা।
- বাজেট নথি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রস্তুত করা।
- সরকারের আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বাজেটে উপস্থাপন করা।
- সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বাজেট প্রক্রিয়ায় কিছু অগ্রগতি করলেও এখনও জনগণের কাছে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
কেন এই আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন গ্যাস, কয়লা, বালু এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো থেকে রাষ্ট্র বিপুল রাজস্ব আয় করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে, এসব খাতে চুক্তির প্রক্রিয়া এবং আয়ের সঠিক হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না।
এর আগে আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা সংস্থা ও দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও একাধিকবার জানিয়েছে, সম্পদ খাতে গোপনীয়তা দুর্নীতির ঝুঁকি বাড়ায়। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থায়ও প্রভাব ফেলে।
প্রতিবেদনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই আহ্বান বাংলাদেশের প্রতি একটি কূটনৈতিক বার্তা। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে। তাই অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উন্নত হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার বলছে, তারা ধীরে ধীরে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে কিছু তথ্য উন্মুক্ত করলেও এখনও বাজেট ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পুরোপুরি জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয়।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান
প্রতিবছর স্টেট ডিপার্টমেন্টের এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বৈশ্বিকভাবে কোন কোন দেশ অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার মানদণ্ড পূরণ করছে তা মূল্যায়ন করা হয়। প্রতিবেদনটি শুধু কূটনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নীতি ও কৌশল ঠিক করে।
বাংলাদেশ যদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে বৈদেশিক বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহায়তা ও বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন খাতে দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। চুক্তির শর্তাবলী ও প্রকৃত আয়ের পরিমাণ প্রকাশ না হওয়ায় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না, রাষ্ট্র কতটা লাভবান হচ্ছে।
ঢাকার এক শীর্ষ অর্থনীতিবিদের মতে, “প্রাকৃতিক সম্পদ খাত দেশের জনগণের সম্পদ। তাই এই খাতের চুক্তি ও আয়ের হিসাব জনগণের জানা অধিকার।”
তবে কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, সব তথ্য উন্মুক্ত করা হলেও তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত না হলে কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা আসবে না।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ও চুক্তি আলোচনায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। অনেক সময় নিরাপত্তা বা কৌশলগত কারণে এসব তথ্য গোপন রাখা হয়।
তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জনগণের জানার অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশই লাভবান হবে।
পরিশেষে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা। প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে তথ্য উন্মুক্ত করলে তা শুধু স্বচ্ছতা নয়, বিনিয়োগ ও জনগণের আস্থাও বাড়াবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার কতটা দ্রুত ও কার্যকরভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। আগামী বাজেট প্রক্রিয়া ও নীতিগত সিদ্ধান্তে এর প্রতিফলন দেখা যাবে কি না, তা এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এম আর এম – ১৪২৩,Signalbd.com