গাজায় রক্তের তীব্র সংকট, রক্তদাতারাও অপুষ্টিতে

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি হামলা ও অবরোধের ফলে চরম মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে রক্তের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, অথচ প্রয়োজনীয় রক্তদাতারা নিজেই অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর ফলে গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কার্যত অচল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ভেঙে পড়ছে হাসপাতালগুলো
গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইতিমধ্যে চরম ভেঙে পড়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার বোমা হামলায় হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংক, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ বহু অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কিছু কিছু হাসপাতাল আংশিকভাবে চালু থাকলেও, সেখানে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক, ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
আল-শিফা, আল-আকসা এবং নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিন দিন রক্তের ঘাটতি বাড়ছে। অনেক সময় রোগীদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রক্ত খুঁজেও ব্যর্থ হচ্ছেন।
অপুষ্টির শিকার রক্তদাতারা, রক্ত নেওয়া যাচ্ছে না
যেসব মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে এগিয়ে আসছেন, তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল যে, রক্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়ার ফলে তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং তীব্র পানিশূন্যতায় আক্রান্ত। চিকিৎসকদের মতে, এসব দাতাদের থেকে রক্ত নিলে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং একইসঙ্গে রক্তের মান ও নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আল-শিফা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের প্রধান আমানি আবু ওউদা জানিয়েছেন, “অনেক রক্তদাতা রক্ত দেওয়ার সময়ই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এতে শুধু রোগীই নয়, দাতাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। ফলে আমাদের তাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।”
খাদ্য সংকটের কারণে মৃত্যুর মিছিল
খাদ্যাভাব গাজায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, গাজা উপত্যকার প্রায় সব খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে পুরো অঞ্চলের মানুষ এখন ত্রাণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের, আর সামগ্রিকভাবে অনাহারে মারা গেছে ১৯০ জনেরও বেশি মানুষ। শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস জানিয়েছেন, গাজায় বর্তমানে ১৪ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি রোগীর জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু রক্ত, ওষুধ, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
তিনি আরও বলেন, “গাজায় মানবিক পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই হস্তক্ষেপ করতে হবে।”
ইসরায়েলি অবরোধে চিকিৎসা ও জ্বালানি সরবরাহও বন্ধ
ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের কারণে গাজায় ওষুধ এবং জ্বালানি সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলো বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ছে, অক্সিজেন সাপ্লাই ব্যাহত হচ্ছে, এবং নবজাতকদের জীবন হুমকিতে পড়ছে। গত কয়েক মাসে ১০০টিরও বেশি চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে শুধুমাত্র জ্বালানির অভাবে।
শিশুর কান্না, মায়ের অশ্রু—মানবতার পরাজয়
গাজা সিটির প্রতিটি কোণে এখন শুধু কান্না আর হাহাকার। শিশুদের কান্না, মায়েদের দুশ্চিন্তা, এবং বাস্তুহারা মানুষের চিৎকার গোটা অঞ্চলকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা বেঁচে আছি কিনা সেটাই জানি না। প্রতিদিন শুধু শুনি, কে মারা গেল, কোথায় বোমা পড়ল।”
আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন
বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরা। বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে গাজায় এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র আমরা দেখতে পাব, যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পথ কী?
গাজার সংকট এখন শুধু একটি অঞ্চল নয়, পুরো মানবতার সংকট। রক্ত, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি নেই। প্রশ্ন এখন, বিশ্ব কি মানবতার পক্ষে দাঁড়াবে, নাকি এই নীরবতাই আরও মৃত্যুর মিছিল তৈরি করবে?
এম আর এম – ০৭৪২, Signalbd.com