ভারতের অনুরোধে ইলিশ পাঠানো হচ্ছে, কোনো চাপে নয় : মৎস্য উপদেষ্টা

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু দেশের মানুষের কাছেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের মানুষের কাছেও ভীষণ জনপ্রিয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজার উৎসব এলেই ইলিশের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, ভারতের অনুরোধে সৌজন্যবোধের অংশ হিসেবে ১২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোনো চাপের কারণে নয়, কেবলমাত্র উৎসবের প্রতি সম্মান ও দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “দুর্গাপূজা বাঙালিদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছরই ভারত থেকে আমাদের কাছে ইলিশ পাঠানোর অনুরোধ আসে। এই সৌজন্যের অংশ হিসেবে আমরা এ বছর ১২০০ মেট্রিক টন ইলিশ পাঠাচ্ছি, যা গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।”
বাজারে সরবরাহ কম, দাম বেশি
দেশীয় বাজারে ইলিশের দাম এ বছর চোখে পড়ার মতো বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ উৎপাদন কমে যাওয়া। উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানান, জুলাই মাসে গত মৌসুমের তুলনায় প্রায় ৩৭ শতাংশ কম ইলিশ ধরা পড়েছে। আগস্ট মাসে কমেছে আরও ৪৭ শতাংশ। এর ফলে সরবরাহ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে গেছে।
এক কেজি আকারের ইলিশ এখন অনেক জায়গায় ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্দিষ্ট জায়গায় সাশ্রয়ী মূল্যে ইলিশ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জাটকা নিধনের প্রভাব
ইলিশ উৎপাদন কমার অন্যতম বড় কারণ হলো জাটকা নিধন। যদিও সরকার দীর্ঘদিন ধরে জাটকা নিধন বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে, তবুও নদীতে অবৈধভাবে জাটকা ধরা এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ফরিদা আখতার জানান, “এ বছর ব্যাপক হারে জাটকা ধরা পড়ায় প্রজনন কমেছে। ফলে বড় আকারের ইলিশ বাজারে আসেনি।”
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ২০-২৫ শতাংশ ইলিশ অকালেই ধরা পড়ে যায়। এর ফলে প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
প্রবাসীদের জন্য ইলিশ রপ্তানি
শুধু ভারত নয়, প্রবাসী বাঙালিদের দাবির মুখেও সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ১১ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রায় ৫০ লাখ বাংলাদেশি প্রতিবছর দুর্গাপূজা ও ঈদে দেশি ইলিশ খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন।
ফরিদা আখতার বলেন, “দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রবাসীদেরও কথা ভাবতে হচ্ছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে অনুরোধ করে আসছেন। তাই ধাপে ধাপে আমরা রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছি।”
কৃষিতে প্রণোদনা, মৎস্য খাতে নেই
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু কৃষির মতো মৎস্য খাতে পর্যাপ্ত প্রণোদনা নেই। এ বিষয়ে ফরিদা আখতার বলেন, “কৃষিতে যেমন প্রণোদনা রয়েছে, মৎস্য খাতে তেমন কোনো বিশেষ প্রণোদনা নেই বললেই চলে। তবে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি।”
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মোট প্রোটিনের ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে, আর এর মধ্যে প্রায় ১২ শতাংশই শুধু ইলিশ থেকে আসে। সুতরাং এই খাতকে আরও গুরুত্ব দিয়ে সরকারি ভর্তুকি ও সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।
ইলিশ রপ্তানি ইতিহাস ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশ ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু করে। মূলত পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজা উপলক্ষে ইলিশ পাঠানো একটি কূটনৈতিক সৌজন্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইলিশ একটি বড় রপ্তানি পণ্য। প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ বিদেশে রপ্তানি হয়, যার বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম একটি মাধ্যম।
নদীর পরিবেশ ও চ্যালেঞ্জ
ইলিশ মূলত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ উপকূলীয় নদীগুলোতে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদী ভাঙন, দূষণ ও পানির প্রবাহ কমে যাওয়া ইলিশের প্রজননে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকরা বলছেন, যদি এখনই নদী খনন, অবৈধ জাল বন্ধ এবং জাটকা রক্ষা কার্যক্রম জোরদার না করা হয়, তাহলে আগামী ২০ বছরে ইলিশ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশের জনপ্রিয়তা
শুধু ভারত বা মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারেও ইলিশের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি ও ভারতীয় বাঙালিরা ইলিশ কিনতে আগ্রহী। তবে আন্তর্জাতিক পরিবহন খরচ ও শুল্ক জটিলতার কারণে এখনও সেই বাজার পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।
প্রশাসনিক উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সরকারি পর্যায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- নদীতে মা ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধে কঠোর অভিযান
- জাটকা রক্ষা কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করা
- চাষযোগ্য পুকুরে কৃত্রিম ইলিশ চাষ প্রকল্প শুরু
- বিদেশে রপ্তানি নীতিমালা সহজীকরণ
ফরিদা আখতার বলেন, “আমরা চাই দেশের মানুষ যেন ন্যায্যমূল্যে ইলিশ খেতে পারে এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক বাজারও ধরে রাখতে পারি।”
ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পরিচয়ের অংশ। ভারতের দুর্গাপূজায় ইলিশ পাঠানোকে কেউ কেউ সমালোচনা করলেও সরকার মনে করছে এটি সৌজন্যের অংশ এবং দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক। তবে দেশের ভোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ইলিশ নিশ্চিত করা এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
MAH – 12835 Signalbd.com